শেষ ফাল্গুনের বৃষ্টি দেশের চা-বাগানগুলোর জন্য আশীর্বাদ হলেও সেই বৃষ্টির দেখা নেই চা-বাগানগুলোতে। ফলে ইয়াং টি বের হতে পারছে না। এদিকে চৈত্র মাস শুরু হয়ে গেছে। বাগানগুলোতে ‘খরা’ভাব চলছে। ভ্যাপসা গরমে বাগানগুলোতে অনেক সময় ‘রেড স্পাইডারের’আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাগান মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ শুরু হয়েছে। নর্থ সিলেট ভ্যালি বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নোমান হায়দার চৌধূরী শুক্রবার সন্ধ্যায় ইত্তেফাককে বলেন, ‘‘বেশির ভাগ বাগানে এখনো ভালোভাবে ‘পাতি’ (ইয়াং-টি) বের হয়নি বৃষ্টির অভাবে। আকাশে মেঘের ঘোরাঘুরি আছে। এক পশলা বৃষ্টি ঝরলেই বাগানগুলো পুরোদমে সজীব হয়ে উঠবে। চা-শ্রমিকরা ‘পাতি’ তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন।”
এদিকে সাধারণত মার্চের প্রথম দিকে বাগানে-বাগানে ‘চা-চয়ন’ (পাতি তোলা) শুরু হয়ে থাকে। কিন্তু এবার মার্চেও প্রথম বৃষ্টি প্রলম্বিত। সে কারণে একটু পেছনে পড়েছে বেশির ভাগ বাগান। বৃষ্টির অভাবে বাগানে বাগানে এ এখনো চা-চয়ন উত্সব শুরু হয়নি। কিছু বাগানে চা-চয়ন শুরু হলেও আনন্দ আগের মতো দেখা দেয়নি। সিলেটের প্রাচীন মালনীছড়া চা-বাগানে বিশিষ্ট চা-প্ল্যান্টার ড. রাগিব আলী এ মৌসুমের ‘চা-চয়ন’ উদ্বোধন করেন কয়েক দিন আগে। অন্যদিকে মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জে দলই চা-বাগানে মালিক শ্রমিক মিলে বৃহস্পতিবার ‘চা-চয়ন’ উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলই চা-বাগানের ব্যবস্থাপক আজগর আলীসহ বাগানের অন্য কর্মকর্তা। হিন্দু শ্রমিকরা রীতি অনুযায়ী পূর্জা-পার্বণ আর মুসলিমরা দোয়া-মাহফিল করেন।
গত বছর দেশের ১৭০ বছরের ইতিহাস ভঙ্গ করে সারা দেশের ১৬৮টি চা-বাগান থেকে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উত্পাদন হয়। চা উৎপাদনের রেকর্ড ভঙ্গের বিষয়টি সবাইকে আনন্দিত করলেও বাগান মালিকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই—এই মন্তব্য করে নর্থ সিলেট ভ্যালি বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নোমান হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে শিল্পটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। গত বছরের উৎপাদিত চা বিক্রয় করা যাচ্ছে না। নিলাম বাজারে চা-এর দাম নেই। কেজি প্রতি ১৬০-১৭০ টাকা কি করে বিক্রয় করা যায়। উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘এ বছরও আমরা চাই উৎপাদন আরও এক ধাপ এগিয়ে যাক। কিন্তু সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে বাঁচাতে এখুনি এগিয়ে আসতে হবে।’
চা-সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের চা-শিল্পকে বাঁচাতে হলে চা-এর নিলাম-মূল্য প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ‘চোরাচালানের মাধ্যমে নিম্ন-মানের চায়ের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। বাগান মালিকরা বলেন, চায়ের নিলাম মূল্য না বাড়লেও শ্রমিক মজুরি ও রেশন, জ্বালানি, সার ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চা প্যাকেটজাতকরণের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি কোম্পানি চায়ের নিলাম বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ব্যাংক ঋণ পরিশোধের উচ্চ হারও এই শিল্পের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
কৃষিপণ্য হিসেবে চা দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে সিলেটের ১৩৮টিসহ দেশের ১৬৮টি চা-বাগান থেকে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়। যা বাংলাদেশে চা-চাষের ১৭০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উৎপাদন। ২০২২ সালে চা উৎপাদিত হয় ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি। আগের বছর ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। এখানেই শেষ নয়, চা-শিল্পের সঙ্গে কয়েক লাখ শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে।
অন্যদিকে মধ্য ফাল্গুনে সামান্য বৃষ্টির ছোঁয়ায় প্রুনিং (ছাঁটাই) করা চা-গাছে নতুন কুঁড়ি ফুটছে। এসব বাগানে লেগেছে প্রাণের ছোঁয়া। সতেজ, কোমল সবুজের সমারোহ বাগানগুলোতে। চায়ের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছরের শুরুতেই বাগানগুলোতে চা-গাছের ডাল ছাঁটাই করা হয়। এটাকে প্রুনিং বলা হয়। এতে চায়ের উৎপাদন ও গুণমান ভালো হয়। এবার প্রুনিংয়ের পর মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির ছোয়া পড়েছে কোনো কোনো বাগানে। সেসব চা গাছগুলোতে নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। শ্রীমঙ্গলের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান বলেছেন, বৃহত্তর সিলেটে ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টিপাত হয় ১০৪ দশমিক ১ মিলিমিটার। চায়ের রাজধানী হিসেবে খ্যাত শ্রীমঙ্গলে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৭৩ মিলিমিটার। যা চা এবং কৃষির জন্য আশীর্বাদ।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের (বিসিএস) সিলেট শাখার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী জানান, চা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এই বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিল। বৃষ্টিপাত চায়ের জন্য অনেক উপকারী। বিশেষত ‘ইয়াং’ টি বা নতুন চা-গাছ, যেগুলোর জন্য বেশি প্রয়োজন। বৃষ্টির ফলে প্রুনিং করা চা-গাছগুলো কুঁড়ি ছাড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির জন্য সঠিক সময়ে চা-গাছের কুঁড়ি চলে আসবে। তাড়াতাড়ি চা-পাতা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যাওয়া সম্ভব হবে।