দিনাজপুর প্রতিনিধি- সম্প্রতি পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে দিনাজপুর অনেক গুরুত্বের দাবিদার। তবে অযত্ন-অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে সেখানকার শতাব্দী প্রাচীন রাজবাড়ী এখন ধ্বংসের মুখে। বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত ঔপনিবেশিক কিংবা প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের এ রাজবাড়ী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও এর উন্নয়নে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। স্থানীয়ভাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকেও দেখা গেছে নির্বিকার-নিশ্চুপ। জীর্ণ অবস্থায় টিকে থাকা এ মন্দির দেখতে আসা বিভিন্ন স্থানের মানুষ তাই যার পর নাই হতাশ ও ব্যথিত। তাদের প্রশ্ন, ঐতিহ্যবাহী এ কীর্তি কেন প্রথম থেকেই সংরক্ষণ করা হয়নি।
দেশ বিভাগের পর দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ দিনাজপুর রাজবাড়ী ত্যাগ করে সপরিবারে পাড়ি জমান ভারতে। তখন থেকেই অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের মুখে পড়ে রাজবাড়ীটি। দীর্ঘদিন প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয় এটি। গাঠনিক শৈলী বিচারে প্রাক-ঔপনিবেশিক থেকে মোগল যুগের শেষাংশে নির্মিত এ দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন তার আগের গাঠনিক অবস্থায় আর টিকে নেই। বলতে গেলে নানামুখী পরিবর্তনে এর প্রকৃত অবস্থান চিহ্নিত করে গাঠনিক অবস্থান, অলঙ্করণ শৈলী, অবস্থানগত বিস্তৃতি আর স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা কঠিন হয়ে গেছে।
দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের ট্রাস্টি সদস্য ও প্রেস ক্লাব সভাপতি চিত্ত ঘোষ জানান, ট্রাস্টের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজবাড়ীর মূল মন্দিরের টাইলস, টিন ও আনুষঙ্গিক কাঠামো পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ধরনের সংস্কার চলছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাজবাড়ীর মূল ভবনসহ বিভিন্ন ভবনের লোহার বিমসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হওয়ায় রাজবাড়ী এখন আর চেনার অবস্থায় নেই। অন্যদিকে রাজবাড়ীর মূল ভবন-সংলগ্ন স্থানে সরকারিভাবে একটি এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। অবৈধভাবে গড়ে তোলা এ এতিমখানা পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনেরও পরিপন্থী।
মেহরাব আলীর লেখা ‘দিনাজপুরের ইতিহাস’ বই থেকে রাজবাড়ীর প্রবেশপথে একটি নাগ দরজার উপস্থিতি সম্পর্কে জানা গেছে। কালো পাথরে নির্মিত দরজার চৌকাঠের উচ্চতা ছিল সাত ফুটের বেশি। সাপের মূর্তি দিয়ে এ দরজা তৈরির ঘটনা বাংলাদেশ তো বটেই, উপমহাদেশেও বিরল। বর্তমানে নাগ দরজাটি ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। চারদিক থেকে উঁচু প্রাচীর ঘেরা রাজবাড়ীর অনেকগুলো প্রবেশদ্বার। এর মধ্যে ধর্ম, সিংহ, বেলতলী, ঠাকুরবাড়ী, হাতিশালা ও হীরাবাগ দেউড়ি অন্যতম। রাজবাড়ীর প্রধান দুটি অংশ— আয়নামহল ও রানীমহল। এছাড়া আছে ঠাকুরবাড়ী ও হীরাবাগ এলাকা। আয়নামহল দ্বিতল ভবন। এ ভবনের দোতলায় রাজদরবার, জলসাঘর, মিছিলঘর, অতিথি ভবন, সভাকক্ষ ও নিচতলায় রাজকীয় পাঠাগার, কোষাগার ইত্যাদি। রাজা প্রাণনাথ ও রাজা রামনাথের আমলে আয়নামহল নির্মিত হয়। এ মহলের অধিকাংশ কক্ষ ভেঙে পড়েছে। রানীমহলের চারদিকের ভগ্নমান প্রাচীরগুলো জরাজীর্ণ কিছু অস্তিত্ব ছাড়া সাবেক ভবন আর নেই। ত্রিশের দশকে তা ভেঙে ওই স্থানের ওপর আধুনিক ডিজাইনের দ্বিতল রানীভবন নির্মিত হয়। মূল প্রাসাদসহ বৃহত্তর রাজবাড়ী প্রায় ১০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
মূল বাড়ি থেকে একটি বিশেষ দূরত্বে গভীর পরিখার দ্বারা বেষ্টিত আউটার রাজবাড়ী এলাকার আয়তন ছিল ৩০০ বিঘার মধ্যে। এ অংশে ম্যানেজার ভবনসহ উচ্চপদস্থ আমলা কর্মচারীদের বাড়ি, রাজ অতিথি ভবন, পোস্ট অফিস, দাতব্য চিকিত্সালয়, আখড়া প্রভৃতি ছাড়াও কামার, ডোম, মেথরসহ পাইক-পেয়াদা, কোচোয়ান, দারোয়ানদের কলোনি ছিল। এর পরও ছিল রাজকীয় ফুল বাগান, সবজি বাগান এবং পদ্ম সাগর, শুক সাগর, আনন্দ সাগর, মাতা সাগর ও রাম সাগরজাতীয় বৃহত্ দীঘি। দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই এ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার জরুরি।