স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার প্রসারে ধনী ও সামর্থবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ সমাজে বিরাজমান সকল ধরনের কুসংস্কার, কূপমন্ডুকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলবে। যা উগ্র-ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের কার্যক্রমের সাফল্য নিশ্চিত করবে।
তিনি বলেন, ‘আমি সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি নিজ নিজ গ্রামের আশপাশের দরিদ্র মানুষকে সাহার্য করতে, মেধাবীদের উচ্চশিক্ষায় সহায়তা করতে, যাতে তারা বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে কাজী মাহবুব উল্লাহ স্মৃতি পদক প্রদান অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে এ কথা বলেন।
দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেবল শিক্ষাই পারে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনারবাংলা গড়ে তুলতে।’
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জোবায়দা এম. লতিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট লেখিকা ও কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। স্বাগত বক্তৃতা করেন বেগম নিলুফার জাফরউল্লাহ এমপি।
২০১৫ সালের পুরস্কারপ্রাপ্ত গুণীজনের মধ্যে এমিরেটাস অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিন পূর্ববর্তী পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
এবারের কাজী মাহবুব উল্লাহ স্মৃতি পদক প্রাপ্তরা হচ্ছেন- সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় আনিসুল হক, বিজ্ঞানে পাটের মলিকিউলার বায়োলজি নিয়ে বিশেষ গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান, খেলাধূলায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং বিশেষ পুরস্কার হিসেবে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী।
এদিন ছিল বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্টের ২৭তম পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, ১৯৭৮ সাল থেকে ট্রাস্ট এই পদক প্রদান করে আসছে।
পুরস্কার হিসেবে এক লাখ টাকার চেক, সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট এবং উত্তরীয় প্রদান করা হয়।
উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। শ্রেণীকক্ষগুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম সন্নিবেশিত করা হয়েছে যাতে করে শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির সংস্পর্শে এসে তাদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
’বিত্তবানেরা এক্ষেত্রে এগিয়ে এসে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশ রুম প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চশিক্ষায় সহায়তার মাধ্যমে মেধাভিত্তিক আলোকিত জাতি এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে।’
শেখ হাসিনা বলেন, সারাদেশে বছরের প্রথম দিনটিতে বই উৎসবের মাধ্যমে দেশের সকল বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ, এক হাজার টাকা সীডমানি জমা রেখে তার ইন্টারেষ্টের টাকায় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাষ্টের মাধ্যমে ১ লাখ ২৮ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান, ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাইমারী স্কুলকে জাতীয়করণ,এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ প্রভৃতি বর্তমান সরকার গৃহীত এই সেক্টরের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
তিনি দেশের উন্নয়নে গবেষণার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, দেশের উন্নয়নে গবেষণা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেই গবেষণার জন্য ১২ কোটি টাকা প্রথম থোক বরাদ্দ দেয়। পরবর্তীতে এই বরাদ্দের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়।
যে কারণে, দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের ফসল, লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানসহ বিভিন্ন জাতের ধান ও ফসল আবাদ করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিতে সক্ষম হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ নজর দেন। পাক বাহিনীর নারকীয়-বিভৎস ধ্বংসযজ্ঞে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া দেশে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তিনি ৩৬ হাজার ১শ’ ৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। একই সঙ্গে তিনি ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭শ’ ২৪ জন শিক্ষকের পদ সরকারিকরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকান্ডের মতই বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০১ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এসে গবেষণার কাজকে বন্ধ করে দেয়।
তিনি এ সময় পচাত্তর পরবর্তী সেনা সরকারগুলোর তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাস ও কৃষ্টিকে তুলে না ধরে বরং ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টার কঠোর সমালোচনা করেন।
দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-এ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৯৮’ লাভ করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সরকারের পর ৪১ বছরেও কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়নি। আমি ২০১৩ সালে দেশের ২৬ হাজার ১শ’ ৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করি। এসব বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৩ হাজার ৮শ’ ৪৫ জন শিক্ষককে সরকারিকরণের ঘোষণা দেই। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা নীতি প্রণয়নের কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল-সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন। জাতির পিতার স্বপ্নকে সামনে রেখে উচ্চশিক্ষায় সহায়তার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ গঠন করি। আমি এবং আমার ছোট বোন রেহানা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ সর্বস্ব দান করে এই ট্রাষ্ট গঠন করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ট্রাস্টের সর্ববৃহৎ কার্যক্রম হচ্ছে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ। এখানে গরীব মানুষের চিকিৎসার দেয়া হয়। মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানির সহযোগিতায় পরিচালিত এই হাসপাতালের লভ্যাংশ গরিব মানুষের চিকিৎসায় ব্যয় হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকারের ধারাবাহিক দুই মেয়াদের গত সাত বছর অর্থনীতির সবগুলো সূচক ছিল ইতিবাচক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৩শ’ ১৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পাঁচ কোটির বেশি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে। সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার চালু হয়েছে। ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে লোড শেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে।
তিনি ২০২১ সাল নাগাদ দেশের সব ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সামনে রোল মডেল। বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া পাঁচটি দেশের একটি- বাংলাদেশ।
অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করেছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই নির্মাণ কাজ শুরু করার পর সমগ্র বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করতে পারে তারা নিজস্ব টাকায় পদ্মার ওপর সেতুও নির্মাণ করতে পারে।’