নিজস্ব সংবাদদাতা- ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রেখে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ পাস হয় ২০১১ সালে। এর মধ্য দিয়ে বাতিল করা হয় প্রচলিত ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) প্রথা। যদিও এখনো পুরনো ডিও প্রথায়ই ভোজ্যতেল বিক্রি করছে টিকে গ্রুপ। অভিযোগ উঠেছে, ডিও প্রথা চালু রেখে সরবরাহ আদেশ নিয়ে মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে না গ্রুপটি। অথচ নগদে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে তারা। এর মাধ্যমে ভোজ্যতেলের বাজারে সংকট তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। কারণ ভোজ্যতেলের বাজারের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তারাই।
এক মাস আগে টিকে গ্রুপের শবনম মিলের নামে সাতটি ডিও ক্রয় করেন বগুড়ার মেসার্স আজাদ স্টোরের স্বত্বাধিকারী আবদুল মতিন সরকার। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে মিলগেটে ট্রাক পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো তেল উত্তোলন করা যায়নি। মিল কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ে আমদানিকৃত ভোজ্যতেলবাহী জাহাজ দেশে না পৌঁছায় সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানালেও নগদ মূল্যে বেশি দামে একই মিল থেকে অনেকেই ভোজ্যতেল সংগ্রহ করছেন। একই ধরনের অভিযোগ করেন পাবনার মেসার্স জলিল স্টোরের স্বত্বাধিকারী বুলবুল আহমেদ। তিনি বলেন, ডিও ক্রয়ের দুই সপ্তাহের বেশি পেরিয়ে গেলেও এর বিপরীতে ভোজ্যতেল উত্তোলন করতে পারেননি। এতে বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী ভোজ্যতেল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে টিকে গ্রুপের পাঁচ-ছয় হাজার ডিও রয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। এসব ডিওর বিপরীতে মিলগেট থেকে তেল উত্তোলন করতে গেলে অধিকাংশ সময়ই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে তাদের। সময়মতো পণ্য না পেয়ে চলতি সপ্তাহে টিকে গ্রুপের মিলগেটে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এ বিষয়ে টিকে গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কালামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না।’ প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (ভোজ্যতেল) মো. জসিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি প্রক্রিয়ায় শিপমেন্ট জটিলতায় মিল থেকে ভোজ্যতেল সরবরাহে সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। বর্তমানে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় মিল থেকে ৩০-৪০ ট্রাক ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই এ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’ তবে ডিওর বিপরীতে সরবরাহ না দিয়ে নগদে ভোজ্যতেল বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে শাস্তির কথাও বলা আছে আইনে। আইন অমান্য করলে সরবরাহকারীকে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এজন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে হবে। টিকে গ্রুপের বিরুদ্ধে ডিও বিক্রি ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রচলিত আইনে ডিও প্রথার সুযোগ নেই। তার পরও এটি চালু রাখলে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরকার বিষয়টি নজরদারি করছে না। তবে কেউ যদি সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করেন, তাহলে তদন্তসাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। খাতুনগঞ্জের একাধিক ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী জানান, টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বে-ফিশিংয়ের মিলে প্রতিদিন গড়ে ১৭০ ট্রাক (প্রতি ট্রাকে ৩০০ মণ) ভোজ্যতেল সরবরাহ করার কথা। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহ প্রায় এক-চতুর্থাংশ অর্থাত্ ৪০ ট্রাকে নেমে আসছে।
সরবরাহ সংকটে সম্প্রতি বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বুকিংদর কমা সত্ত্বেও স্থানীয় বাজারে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে মণে প্রায় ৫০০ টাকা। এর আগেও গত বছরের জুনে ডিওর বিপরীতে মিলগেট থেকে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল টিকে গ্রুপের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে টিকে গ্রুপের আমদানি করা ৫ লাখ ২৮ হাজার ৯৭৫ টন ভোজ্যতেল শুল্কায়ন হয়েছে। এর মধ্যে টিকে গ্রুপের চট্টগ্রামভিত্তিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান বে-ফিশিং করপোরেশন লিমিটেড আমদানি করেছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০ টন পরিশোধিত পাম ও ৫৪ হাজার ৭৬৩ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল। আর ঢাকাভিত্তিক শবনম ভেজিটেবল অয়েল আমদানি করেছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৬০ টন পরিশোধিত পাম। চট্টগ্রামের একাধিক শিল্প গ্রুপ ভোজ্যতেল আমদানি বাণিজ্যে শীর্ষস্থানীয়দের কাতারে থাকলেও বিশ্ববাজারে ক্রমাগত পণ্যের দরপতন, দেশীয় অর্থনীতিতে মন্দা এবং ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে এ খাত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে অনেকে। এস আলম গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, এমইবি গ্রুপ, রুবাইয়া ভেজিটেবল ভোজ্যতেল আমদানি কমিয়ে দিয়েছে।
ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, দেশে প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টন। এর মধ্যে রোজা ও কোরবানি ঈদের আগে এর দ্বিগুণ চাহিদা তৈরি হয়। দেশের কয়েকটি ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যানুসারে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে (জাহাজ ভাড়াসহ) ৫৭৫ ডলার। দেশের বাজারে পরিশোধন ও আনুষঙ্গিক খরচসহ প্রতি মণ পাম অয়েল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে ভোজ্যতেলের দাম মণপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। মূলত ভোজ্যতেল আমদানি মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে আসার পাশাপাশি এসও প্রথা বাস্তবায়ন ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে গঠিত মনিটরিং কমিটির দুর্বল তদারকিতে পণ্যটির দাম নিয়ে কারসাজি এখনো চলছে।
পরিবেশক আইনের ৫(১) ধারামতে, এ আদেশ জারির ৯০ দিনের মধ্যে কোম্পানিগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে দিতে নিজস্ব পরিবেশক নিয়োগ করবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একাধিক আমদানিকারকের পরিবেশক হতে পারলেও কোনো আমদানিকারক পরিবেশকের বাইরে কারো দ্বারা পণ্য বাজারজাত ও বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানি এখন পর্যন্ত শতভাগ পরিবেশক নিয়োগ দেয়নি। এদিকে পরিবেশক আইন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটি নামে তিনটি কমিটি কার্যকর থাকার বিধান রয়েছে। কমিটিগুলো প্রতি মাসে অন্তত একটি সভা আহ্বান করে আইনটি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে বলে হলেও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে এসব কমিটির কার্যক্রম। প্রতি বছর রোজার মাসে কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলেও সারা বছর এর কোনো কার্যক্রমই চোখে পড়ছে না। বিষয়টি স্বীকার করেছেন ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তাও। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশক আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধান রাখা হলেও তদারকির অভাবে আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ীরা এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো ভঙ্গ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। আইনের ২২ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে, এ আদেশের কোনো বিধান বা শর্ত লঙ্ঘন করা হলে তার বিরুদ্ধে ‘কন্ট্রোল অব অ্যাসেন্সিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট ১৯৫৬’-এর ৬ ধারায় বর্ণিত বিধানাবলির যত দূর প্রযোজ্য হয়, তার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আইনের ৬ ধারায় সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল বা আর্থিক জরিমানা ও উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কথা বলা আছে। এ পর্যন্ত আইন অমান্যের কারণে কোনো ব্যবসায়িকে শাস্তি দেয়ার নজির নেই।
এ বিষয়ে পরিবেশক প্রথা বাস্তবায়নে জেলা কমিটির সদস্য (পদাধিকারবলে) ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবদুল জলিল বলেন, আমি কর্মস্থলে যোগ দিয়েছি দেড় মাস। এ ধরনের কোনো সভায় আমি যোগ দিইনি। এ বিষয়ে জেনে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।