অগ্রসর রিপোর্ট : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার ১০টি বিদ্যমান প্রকল্পের সঙ্গে আরো বেশকিছু প্রকল্পকে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে কয়েকটি প্রকল্পকে ফাস্ট ট্র্যাক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছি এবং প্রকল্পগুলোর সামগ্রিক বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। কমিটির (ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটি) আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রকল্প পর্যবেক্ষণ করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে তাঁর তেজগাঁওস্থ কার্যালয়ে (পিএমও) ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ মনিটরিং কমিটির পঞ্চম সভায় সভাপতিত্বকালে একথা বলেন।
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত ১০টি প্রকল্প ছাড়াও অন্যান্য বড় প্রকল্পগুলো মনিটর করতে ‘ফাস্ট ট্র্যাক মনিটরিং কমিটি’কে নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সেগুলোতো মনিটর করবোই ভবিষ্যতে আমার মনে হয় এই কমিটি থেকে শুধু এই কয়েকটা দেখলে হবে না আরও অনেকগুলো প্রজেক্ট আছে যেগুলো দেখতে হবে।’ সরকারের ধারাবাহিকতার সুফল তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এই ধারবাহিকতা না থাকলে সরকার পরিবর্তন হলে কাজের ধারাও নষ্ট হয়ে যায়। টানা তিন বার আওয়ামী লীগকে দেশ পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ যে, অন্তত তারা আমাদের এইটুকু সুযোগ দিয়েছে এবং এবার নিয়ে আমরা পর পর তৃতীয় বার এসেছি (রাষ্ট্র পরিচালনায়)। তাতে আমাদের উন্নয়নের কাজগুলো বাস্তবায়নও করতে পারছি এবং মানসম্মতও করতে পারছি।’
পদ্মা বহুমুখী মূল সেতুর নির্মাণ কাজ ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানায় ফাস্ট ট্র্যাক মনিটরিং কমিটি। পদ্মা সেতুসহ ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত ১০টি প্রকল্পের প্রতিটির অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয় এ সভায়।
১০টি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হচ্ছে- পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল), মহেশখালি-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, গভীর সমুদ্র বন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মায়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প।
বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট সচিব ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
পদ্মা বহুমুখী প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরে সভায় জানানো হয়, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় জাজিরা প্রান্তে এপ্রোচ রোডের কাজ-৯১ শতাংশ, মাওয়া প্রান্তে এপ্রোচ রোডের কাজ-শতভাগ, সার্ভিস এরিয়া (২)-শতভাগ, মূল সেতু নির্মাণ কাজ ৮৫ দশমিক ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং নদীশাসনের কাজ ৬৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ৫০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর করেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন। পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতির জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক ঝামেলা গেছে আপনারা জানেন। আমরা আনন্দিত অর্ধেকের বেশি কাজ হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটারের মতো বোধ হয় হয়ে গেছে।’
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত অন্যান্য প্রকল্পের অগ্রগতির চিত্র সম্পর্কে সভায় বলা হয়- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ৩টি প্যাকেজের প্রি-ইনসপেকশন শেষ হয়েছে। প্রকল্পের ভৌত কাজকে ৩৪৪টি অংশে ভাগ করে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল) বাস্তবায়নের ভৌত অগ্রগতি ৪৬ দশমিক ৯ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। মহেশখালি-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম প্রকল্পে- বেজার উদ্যোগে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরী (ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চল, মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, সীতাকুন্ডু অর্থনৈতিক অঞ্চল), মহেশখালি-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম ও সাবরাং ইকো ট্যুরিজম পার্ক এবং জাইকা ও সরকারের সমন্বিত প্রয়াসে মহেশখালি-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রায় ২০টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, বন্দর নির্মাণ, এলএনজি ও এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ অন্যতম।
ঢাকা মাস-র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪০ দশমিক ২ শতাংশ।
এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীতে দৈনিক ৫০০ এমএমসিএফ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ফ্লোটিং স্টোরেজ এন্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) এলএনজি টার্মিনাল’ নির্মাণের কাজ ‘বিল্ট অউন অপারেট এন্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) ভিত্তিতে ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং গত ১৯ আগস্ট, ২০১৮ হতে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছে।
ফাস্ট ট্রাকভুক্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রারম্ভিক কার্যাবলি ও মালামাল সংগ্রহের কাজ ইতোমধ্যে ১০০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া, ভূমি অধিগ্রহণ ও ভূমি হুকুম দখলের কার্যক্রম গড়ে ৯০ দশমিক ৩৩ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে এবং আনোয়ারা-ফৌজদারহাট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্পের পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট দু’টি প্রকল্পের পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ গড়ে ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
‘সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হবে না’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা হারাবো।’ তিনি প্রকল্পের প্রস্তাব থেকে ‘সোনাদিয়া’ নামটি বাদ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে নির্দেশ দেন।
পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬২ দশমিক ৫৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য এ প্রকল্পকে ১৯টি কম্পোনেন্টে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৭টি কম্পোনেন্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। ৬টি কম্পোনেন্ট পিপিপি এর মাধ্যমে ও ৬টি কম্পোনেন্ট জি টু জি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ, কতিপয় পূর্ত কাজ, জাহাজ নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রুটে ডেজিং এবং পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়াও ভূমি অধিগ্রহণ ৫৯ দশকি ২৯ শতাংশ, পূর্ত কাজ ৯৬ দশকি ৪৮ শতাংশ, জাহাজ নির্মাণ ৮২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ডিটেইল মাষ্টার প্ল্যান ৪২ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ রুটে ড্রেজিং শতভাগ, পুনর্বাসন শতাংশ, প্রশিক্ষণ ৩৪ দশমিক ১৪ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬২ দশমিক ৫৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৩০ দশমিক ২২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলেও সভায় জানানো হয়। প্রকল্পটি চীন সরকারের অর্থায়নে জি টু জি পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আরডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৯,২৪৬.৮০ কোটি টাকা (জিওবি ১৮,২১০.১১ ও প্রকল্প সাহায্য ২১,০৩৬.৬৯)। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৩০ দশমিক ২২ শতাংশ।
এছাড়া, দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মায়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩৩ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
দেশের যেকোন নদীতে সেতু নির্মাণের আগে সেই নদীর চরিত্র সম্পর্কে জানার নির্দেশনা প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নদীতে ব্রিজ বা কোন কিছু করতে গেলে আমাদের কিন্তু নদীর চরিত্রটা কেমন, বর্ষাকালে কি রূপ ধারণ করে বা শীতকালে কি রূপ ধারণ করে, এগুলো জেনে নিয়ে কাজ করা উচিত।’ ‘নদীকে শাসন করতে গেলে সে শাসন সে মানবে না। সব নদী সব শাসন মানে না। সেটা মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে পদ্মা নদীর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সেতুটা করার সময় নদী শাসন করে আমি কিন্তু নদী ছোট করতে দেইনি। তিনি বলেন, ‘এই নদীটা অসম্ভব ভাঙনপ্রবণ। এখানে বাঁধ দিয়ে ছোট করতে গেলে এই নদী মানবে না। আমাদের ব্রিজটাই বড় করতে হবে। এখানে জায়গাও রাখতে হবে বাফার জোনও থাকবে। যাতে বন্যার পানিটা ধারণ করতে পারে।’