কৃষি সমাচার- বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবজির চারা উৎপাদন বেশ লাভজনক একটি পেশা। এতে অতি অল্প সময়ে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কারণ অধিকাংশ সবজির রোপণোপযোগী চারার বয়স ৩০-৪৫ দিন বলে একবার চারা তুলে দ্রুত আরেক বার বীজ বপন করা যায়। এতে করে বছরে একটি জমি থেকে ১০-১২ বার চারা উৎপাদন করে বিক্রি করা সম্ভব হয়। খরচ লাভ অনুপাত হিসাব করে দেখা গেছে, সবজির চারা তৈরি করে ১ঃ৫ অনুপাতে অর্থাৎ ১০০০ টাকা খরচ করে কৃষকরা ৫০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
বীজতলার জন্য স্থান নির্বাচন :
নিবিড় পরিচর্যার জন্য বীজতলা খামারবাড়ির কাছাকাছি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আলো বাতাস এবং সেচ ও নিকাশ সুবিধাযুক্ত উর্বর বেলে-দো-আঁশ মাটি বীজতলার জন্য উপযোগী।
বীজতলা তৈরি :
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবজির চারা উৎপাদনের জন্য স্থায়ী বা পাকা বীজতলা সবচেয়ে ভালো। এতে প্রাথমিক ব্যয় একটু বেশি হলেও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা পরিহার করে যেকোনো সময় চারা উৎপাদন করা সম্ভব হয়। উঁচু জমিতে ভালোভাবে নিষ্কাশন নালা তৈরি করে অস্থায়ী বা সাধারণ বীজতলায় ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চারা উৎপাদন করা যায়। বীজতলার মাটি প্রথমে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ঢেলা ভেঙে ঝুরঝুরে ও নরম করে নিতে হবে। এতে মাটির ভেতর খুব সহজেই বায়ু ও পানি চলাচল করতে পারবে, চারার শিকড় সহজে মাটিতে প্রবেশ করে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে। তারপর ৪-৬ ইঞ্চি উঁচু করে বেড তৈরি করে বেডের ওপরের মাটি সমান করে বীজ বপন করতে হবে। বীজতলা তৈরির সময় প্রয়োজনীয় সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
মাটি শোধন :
বীজ বপনের আগে বীজতলার মাটি শোধন করে নিতে হবে। এজন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো- বীজতলার মাটি কুপিয়ে স্বচ্ছ পলিথিন দ্বারা ঢেকে দিয়ে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হবে। পলিথিনের চতুর্দিক মাটির নিচে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিতে হবে যাতে ভেতরের তাপ বের হতে না পারে। রাসায়নিকভাবে শোধন করতে চাইলে ২-৩% ফরমালিন অর্থাৎ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০০-২৫০ মি.লি. ফরমালিন মিশিয়ে বীজতলায় স্প্রে করে ২-৩ দিন পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
তারপর ঢাকনা সরিয়ে ৮-১০ দিন পর অর্থাৎ ফরমালিনের ঝাঁঝালো গন্ধ চলে গেলে বীজ বপন করতে হবে। বীজতলার ওপর খড় বা শুকনো লতাপাতা পুড়িয়েও বীজতলার মাটি শোধন করা যায়। বীজ বপনের আগে বীজতলার চারদিকে সেভিন ৮৫ ডবিস্নউপি পাউডার ছিটিয়ে দিলে পিঁপড়া ও অন্যান্য মাটিস্থ পোকামাকড় বীজ বা চারা ক্ষতি করতে পারে না।
বীজতলায় সার প্রয়োগ :
৩ মিটার (১০ ফুট) দৈর্ঘ্য এবং ১ মি. (সোয়া ৩ ফুট) প্রস্থ আকারের বীজতলা তৈরির জন্য ১০-১৫ কেজি গোবর ও ৩০০-৪০০ গ্রাম হারে টিএসপি মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। আর মাটির উর্বরতা কম হলে গোবর ও টিএসপির পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেয়া যেতে পারে। চারা বড় হতে শুরু করলে ইউরিয়া ও এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
বীজ শোধন :
সুস্থ-সবল চারা উৎপাদনের জন্য বপনের আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে। ভিটাভেঙ-২০০ অথবা বেভিস্টিন ৫০ ডব্লিউপি ১-২% হারে অর্থাৎ প্রতি কেজি বীজের সাথে ১-২ গ্রাম পরিমাণ মিশিয়ে নিতে হবে। বীজতলায় বীজ বপন : বীজ ছিটিয়ে বুনলে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। সারিতে বুনলে লোহা, বাঁশ বা কাঠের ফালি দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাটি সরিয়ে তাতে বীজ ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজ বপনের আগে বীজ কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে নিলে অঙ্কুরোদগম দ্রুত হয়। নিম্নে কয়েকটি সবজির বীজ বপনের সময় এবং ৩ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১ মি. প্রস্থ সাইজের প্রতিটি বীজতলার জন্য বীজের পরিমাণ উল্লেখ করা হলো-
চারার যত্ন :
সবজির চারাকে অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং রোদ থেকে রৰা করার জন্য চাটাই, খড়, শন বা তালপাতা দিয়ে চালা তৈরি করে তার নিচে চারা উৎপাদন করতে পারেন। আবহাওয়ার অবস্থা বুঝে মাঝে মাঝে চালা তুলে চারায় রোদ লাগাতে হবে।
তবে সকাল এবং বিকালে চারায় রোদ লাগানো ভালো। অতিরিক্ত বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য স্বচ্ছ পলিথিন শেডও ব্যবহার করা যায়। সেচের প্রয়োজন হলে ঝরনা দিয়ে সেচ দিতে হবে। বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি যাতে জমে না থাকে সেজন্য পর্যাপ্ত নালার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাটিতে চটা ধরলে সেগুলো সূঁচালো কঞ্চি বা নিড়ানি দিয়ে খুব সতর্কতার সাথে আলগা করে দিতে হবে। ঘন জায়গা থেকে দুর্বল চারা তুলে ফেলে দিতে হবে। ভালো চারা খুব সতর্কতার সাথে তুলে খালি জায়গা পূরণ করা যেতে পারে। চারা তিন পাতা মেলতে শুরম্ন করলে ইউরিয়া ও এমওপি বা পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। এ সার দুটি মাটিতে সরাসরি প্রয়োগ না করা ভালো। সেৰেত্রে প্রতি লিটার পানির সাথে প্রতিটি সার ১-২ গ্রাম হারে মিশিয়ে সিঞ্চন যন্ত্র বা ঝরনা দিয়ে প্রয়োগ করা উত্তম। এ সময়ে সেচের প্রয়োজন হলে সেচের পানির সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন :
বীজ বপনের আগে মাটি বা বীজ শোধন না করলে চারা গজানোর পর কচি চারা রোগাক্রান্ত হতে পারে। অঙ্কুরোদগমরত বীজ আক্রান্ত হলে চারা গজাতে পারে না। অনেক সময় বীজ থেকে চারা গজানোর পর কাণ্ডের মাটি সংলগ্ন স্থানে পচে গিয়ে চারা নেতিয়ে পড়ে।
একে ‘ড্যাম্বিং অফ’ রোগ বলে। বীজতলার মাটি সব সময় স্যাঁতসেঁতে থাকলে বিভিন্ন ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। রোগের সম্ভাবনা থাকলে চারা গজানোর পর সেচের পানির সাথে মারকিউরিক ক্লোরাইড, কপার অঙিক্লোরাইড বা অন্যান্য ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে অথবা অনুমোদিত মাত্রায় মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা বা অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
রোপণের জন্য চারা তোলার সময় : প্রত্যেক ফসলের রোপণাপযোগী চারার বয়স নির্দিষ্ট থাকে। এর বেশি সময় ধরে বীজতলায় চারা রাখলে দিনে দিনে ফসলের ফলন ও মান কমতে থাকে। বীজতলা থেকে চারা তোলা, সংরক্ষণ ও পরিবহন : বীজতলা থেকে চারা তোলার সময় যাতে শিকড় বা কাণ্ড ছিঁড়ে না আসে সেজন্য চারা তোলার আগে একটি হালকা সেচ দিতে হবে। এতে করে চারাগুলো খুব সহজে উঠে আসবে । চারা তোলার পর যত দ্রুত সম্ভব বাজারজাতকরণ করা উত্তম। পরিবহন ও বাজারজাতকরণে বিলম্ব হলে চারা বাজার মূল্য কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চারাগুলো ঠাণ্ডা অন্ধকারযুক্ত স্থানে ঘন করে ছড়িয়ে রেখে মাঝে মাঝে পাতায় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। চারা কিছুটা শক্ত প্রকৃতির হলে নরম কাদাযুক্ত স্থানে গোড়া রেখে দেয়া যেতে পারে। এভাবে ২-৩ দিন পর্যন্ত চারা সংরক্ষণ করা যায়।