অনলাইন ডেস্ক- অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, দূষিত পরিবেশ— ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ও প্রকোপ বৃদ্ধির এসব কারণ জীবনধারারই অংশ হয়ে আছে। জনসংখ্যার চাপ ও সামঞ্জস্যহীন উন্নয়ন এতে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সকাল ৯টায় অফিসে ঢুকতে হলে ৭টার আগে ঘর থেকে বেরোতে হয়। রুদ্ধশ্বাস ছুটতে ছুটতে ভাবতে হয় সময়মতো গাড়ি পাওয়ার কথা, রাস্তায় যানজটের কথা। সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে অভিভাবককে উদ্বেগে ভুগতে হয় তার নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিয়ে। প্রতিনিয়ত এমন মানসিক চাপ ও উদ্বেগ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, গত তিন দশকে দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার শতাংশ। ১৯৮০ সালে দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, আশির দশক থেকেই দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বাড়ছে। ১৯৯০ সালে এতে আক্রান্ত মানুষ বেড়ে দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৩ শতাংশে। এর পর ২০০০ সালে এ হার আরো বেড়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ৩৫-৫০ বছর বয়সীরা। অর্থাৎ দেশের কর্মক্ষম ও পরিণত জনগোষ্ঠীর বড় অংশই এ রোগের শিকার হচ্ছে। আরো যা উদ্বেগজনক তা হলো, ৩৫ বছর অথবা তদূর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী ও ৫৯ শতাংশ পুরুষ এ রোগ সম্পর্কে সচেতন নয়। অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষ এখনো ডায়াবেটিসের প্রকোপ সম্পর্কে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের। টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস হয়ে থাকে জন্মগত বা পরিবেশগত কিছু কারণে। অন্যদিকে টাইপ-২ বা ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস (এনআইডিডিএম) অতিরিক্ত ওজন, উচ্চশর্করা ও কম আঁশযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের কারণে হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৭০ শতাংশ নির্মূল করা সম্ভব। এদিক দেশে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় ইনসুলিনের ওপর নির্ভরতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির তথ্যমতে, দেশের ২০-২৫টি কোম্পানি ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ বাজারজাত করছে। বর্তমানে দেশে ডায়াবেটিস ওষুধের বাজার বার্ষিক প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার। ডব্লিউএইচও ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) গবেষণা অনুযায়ী, ডায়াবেটিসের পেছনে রোগীর ব্যয় এখন তার মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের ১০-১৫ শতাংশ। দেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কমানো গেলে স্বাস্থ্যব্যয় ১১ শতাংশ কমানো সম্ভব বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
ডব্লিউএইচও যে কয়টি রোগকে একুশ শতকের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের বলেছে, ডায়াবেটিস তার অন্যতম। গত তিন দশকে দেশে এ রোগের ব্যাপকতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২৩ শতাংশের মধ্যে এ রোগের উপসর্গ বিরাজমান। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রকোপের মাত্রায় পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশে নগরায়ণের পাশাপাশি বাড়ছে ডায়াবেটিসের মাত্রা। গ্রামের চেয়ে শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে রোগটিতে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস একদিকে যেমন রোগ, তেমনি অন্য রোগের অনুঘটক। ডায়াবেটিস প্রকারান্তরে হূদযন্ত্র, রক্তনালি, বৃক্ক, স্নায়ুতন্ত্র ও চোখের সমস্যা বাড়ায়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস ডিমেনশিয়া অথবা স্মৃতিভ্রষ্টতার ঝুঁকি বাড়ায়।
ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব ও অত্যধিক দুর্বলতা ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আইলেটস অব ল্যাংগারহ্যান্স অকার্যকর হয়ে পড়ে বিধায় অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য এ রোগে আক্রান্তদের ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়। অন্যদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি সচল থাকে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এ রোগের কারণ এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনেই এর সমাধান। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শর্করা ও অন্যান্য খাবার স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম ব্যাহত করে। ফলে দেখা দেয় নানা উপসর্গ। শুরু হয় শারীরিক সমস্যা। দেহ দুর্বল হতে থাকে। কমতে থাকে কর্মক্ষমতা ও উপার্জন। ডায়াবেটিস দীর্ঘমেয়াদি ও অবক্ষয়ী রোগ হওয়ায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হয় দীর্ঘদিন ধরে। এভাবে নীরবে ব্যক্তির ও দেশের অর্থনৈতিক অক্ষমতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ডায়াবেটিস।
স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে রোগীরা অস্বাস্থ্যকর জীবনাচারের কারণেই প্রধানত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে, যা মানুষের শারীরিক কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রসরতা ও পরিবর্তিত জীবনধারায় বেড়ে যাচ্ছে ওজন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বণিক বার্তাকে বলেন, ডায়াবেটিস রোগটি যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই আসছে, তেমনি ব্যক্তিকে ধ্বংসের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবনতিরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং রোগটির বিষয়ে অসচেতনতাই ডায়াবেটিস বিস্তারে সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে জানান তিনি। ডা. রশিদ-ই মাহবুব আরো বলেন, পরিবারের উপার্জনক্ষম লোকটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা হারাচ্ছেন। এর প্রভাবে তার পরিবার ও প্রতিষ্ঠানেরও উপার্জন কমে যাচ্ছে। দিন দিন তার রোগটি প্রকট আকার ধারণ করছে। আর এর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সম্পদ বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে তার পুরো পরিবারকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
ডায়াবেটিস কোনোভাবেই ওষুধ দিয়ে কমানো সম্ভব নয়, এ কথা জানিয়ে ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, এখনই সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। জীবনযাপন পদ্ধতি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন করতে একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও বসবাসের উপযোগী আবাসন গড়তে নীতিমালা করতে হবে।
দেশে ডায়াবেটিসের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও উদ্বিগ্ন বলে জানান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) বাসুদেব গাঙ্গুলী। তিনি বলেন, রোগ প্রতিরোধে সরকার বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি, নিরাপদ খাদ্য ও ওষুধ তৈরির ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। দেশের জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও জোরদার করা হচ্ছে। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণেও তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে জনসচেতনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।