চট্টগ্রাম প্রতিনিধি- ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা কয়লা। তা সত্ত্বেও পুড়ছে জ্বালানি কাঠ। কয়লার ব্যবহার হলেও অনেক সময় তা অতিরিক্ত সালফারযুক্ত। এর ওপর রয়েছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানা। এসব থেকে নির্গত ধোঁয়া বিশেষ করে সালফারে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। এর সঙ্গে রাস্তার ধুলোবালি মিশে বাড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বায়ুর মান নিয়ে যৌথভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিবেশ অধিদফতর ও নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট ফর এয়ার রিসার্চ। এ দুই মহানগরীর বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড যে সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, প্রতিবেদনটিতে তা উঠে এসেছে। যদিও বর্ষা মৌসুমে বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা কিছুটা কমে আসে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইড ফুসফুস, কিডনি জটিলতা ও হ্রদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। হূদযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে বাতাসে থাকা মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সিসা। ঢাকা শহরের বায়ুর মানোন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে ‘ক্লিন এয়ার সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেস)’ প্রকল্প। এর সুফল, ঢাকার বায়ুর বর্তমান অবস্থা ও ২০২০ সালে কোন পর্যায়ে থাকবে, তা যাচাইয়ে সমীক্ষাটি চালানো হয়। পাশাপাশি যাচাই করা হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের বায়ুর অবস্থাও। এর ভিত্তিতেই ‘মডেলড কনসেনট্রেশন অব ক্রাইটেরিয়া এয়ার পলিউশনস ইন ঢাকা অ্যান্ড চিটাগং’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট ফর এয়ার রিসার্চ।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের বায়ুতে প্রতি বছর ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম১০) মিশছে ৫৮ হাজার ৫২৪ টন। এর মধ্যে রয়েছে রাস্তার ধুলো-ময়লা, কারখানার নির্গত ধোঁয়া ও ক্ষতিকর পদার্থ। পাশাপাশি ২০ হাজার ৮১৯ টন অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) তথা লোহা, সিসা, জিংক ইত্যাদির বিষাক্ত জৈব মিশছে বাতাসে। এছাড়া প্রতি বছর ৬০ হাজার ২১৬ টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ১৪ হাজার ৮৬২ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও ৫৩ হাজার ৪৫ টন কার্বন মিশছে ঢাকার বায়ুতে। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামেও বায়ুদূষণ ক্রমেই বাড়ছে। শহরটির বায়ুতে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার ২৮২ টন ক্ষুদ্র বস্তুকণা, ৫ হাজার ৬৮৬ টন অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, ৬ হাজার ২০০ টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ৪ হাজার ৮২ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও ২৯ হাজার ৯২৬ টন কার্বন মিশছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা ও আশপাশে গড়ে ওঠা ট্যানারি, সিমেন্ট, প্লাস্টিক শিল্প ও ইটভাটা থেকে প্রচুর ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়। কোনো ধরনের পরিশোধন ব্যবস্থা না থাকায় সরাসরি তা ঢাকার বায়ুতে মিশছে। চট্টগ্রামের অবস্থাও একই রকম। এছাড়া ঢাকায় মোটরযান বাড়ছে। এর প্রভাবেও বায়ুদূষণ হচ্ছে।
পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকার বাতাসের মান খারাপ হচ্ছে, তা নানা গবেষণায় এর আগেই উঠে এসেছে। এর মূল কারণ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, দূষণ রোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার না করা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। চট্টগ্রামেও সম্প্রতি এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এক্ষেত্রে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বর্তমানে ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ৩৫৩ মাইক্রোগ্রাম। তবে বাণিজ্যিক ও শিল্পঘন এলাকাগুলোয় এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ১ হাজার ২৩৮ মাইক্রোগ্রাম। আর চট্টগ্রামের বায়ুতে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ক্ষুদ্র বস্তুকণা রয়েছে ১৫৪ মাইক্রোগ্রাম। শুধু বাণিজ্যিক ও আবাসিক ঘনবসতি এলাকায় এর পরিমাণ গড়ে ১ হাজার ১৭২ মাইক্রোগ্রাম।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ কতটা বেশি, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শ মান দেখলেই বোঝা যায়। সংস্থাটির হিসাবে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ২০ মাইক্রোগ্রাম ক্ষুদ্র বস্তুকণা গ্রহণযোগ্য। এদিকে ঢাকার বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা রয়েছে গড়ে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম; শুধু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয় যার পরিমাণ গড়ে ৯৩১ মাইক্রোগ্রাম। আর চট্টগ্রামে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা রয়েছে গড়ে ৩৮ মাইক্রোগ্রাম; শুধু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো বিবেচনায় যার পরিমাণ গড়ে ৩৪৪ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম। এ ছাড়া ঢাকার বায়ুতে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড প্রতি ঘনমিটারে রয়েছে গড়ে যথাক্রমে ৬৮ ও ৪৮ মাইক্রোগ্রাম। শুধু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করলে বায়ুর এ দুই উপাদানের পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ হাজার ৩১ ও ৮৭ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বায়ুতে সালফার ডাই-অক্সাইডের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০ মাইক্রোগ্রাম।
এ বিষয়ে কেস প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, বর্ষাকালে বাতাসের বায়ুর মান বেশ ভালোই থাকে। তবে শুষ্ক মৌসুম নিয়ে চিন্তা। এজন্য কেস প্রকল্পের আওতায় বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইটভাটাগুলো আধুনিকায়ন প্রকল্প বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছে। এছাড়া ঢাকার যানজট কমাতে বেশকিছু ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। আশা করা যায়, ঢাকার বাতাসের মান ভবিষ্যতে উন্নত হবে। বায়ুদূষণের কুফলও প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শুধু বায়ুদূষণের ফলে প্রতি বছর প্রচুর মানুষ শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে শুধু ঢাকায় প্রতি বছর প্রায় চার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০০ মানুষ বছরে মারাও যাচ্ছে। আর বায়ুদূষণের ফলে চট্টগ্রামে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার ৪০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে অন্তত ৫০০ জন মারা যায়। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রাশিদুল হাসান বলেন, বায়ুদূষণের কারণে দেশে শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেড় দশক আগে এ ধরনের রোগীদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ ইনহেলার ব্যবহার করত। এখন এর পরিমাণ ৪৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাত্ বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব বাড়ছে। পাশাপাশি অন্যান্য রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে ঢাকার বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া কষ্টকর হয়ে উঠবে। চট্টগ্রামের অবস্থা এখনো তুলনামূলক ভালো। তবে অবস্থার অবনতি যেন না হয়, সেজন্য সেখানেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাতাসে দূষিত পদার্থের বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে, রাস্তার ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ২০২০ সাল নাগাদ বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বাড়বে। আর ইটভাটার দূষণ না কমলে ২০২০ সাল নাগাদ বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণও বাড়বে। এছাড়া পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হলে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে। এতে জ্বালানি হিসেবে পেট্রল বা ডিজেল ব্যবহার বাড়বে, যা বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।