শেষবার তিনি এসেছিলেন ১৯৬৮ সালে। তখনই বলেছিলেন বাড়িটি সংস্কারের কথা। মায়ের মৃত্যুর পর একবার মাতৃভূমিতে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন সুচিত্রা কন্যা মুনমুন সেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। পাবনা শহরে ঢোকার মুখে বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে তিরচিহ্ন জানান দিচ্ছে সুচিত্রা সেনের বাড়ির দিক নির্দেশ। পাবনায় যে কোনও রিকশাওয়ালাকে বললেই নিয়ে যাবে গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে। এখানেই বাংলা চলচ্চিত্রের উপমহাদেশের কালজ্বয়ি নায়িকা সুচিত্রার সেনের বাড়ি।
পাবনার মেয়ে উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ৯২তম জন্মদিন আজ।
দিনটি উপলক্ষে সংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় পাবনার জেলা প্রশাসন ও সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ পাবনা পৃথকভাবে তার স্মৃতি বিজরিত বাড়িতে বাড়িতে এক স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়।
জানা জায়, ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা জেলায় জন্ম নেন এই দীপ্তিময় প্রতিভা। নয় ভাইবোনের মধ্যে সুচিত্রা ছিলেন পঞ্চম। বাড়ির ছোটরা ডাকতেন রাঙাদি বলে। মা-বাবা নাম রেখেছিলেন রমা। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারী নীতীশ রায় তা বদলে রাখেন সুচিত্রা। কিন্তু পাবনার মহাকালী পাঠশালায় খাতায় কলমে তাঁর নাম ছিল কৃষ্ণা দাশগুপ্ত।
পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের একতলা পাকা পৈত্রিক বাড়িতে সুচিত্রা সেনের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তার বাবা করুনাময় দাশগুপ্ত পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারী ইন্সপেক্টর পদে চাকুরী করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিনী। দু’বোনের মধ্যে সুচিত্রা সেন ছিলেন বড়। ছোট বোন হেনা দাশগুপ্ত। শহরের মহাকালী পাঠশালায় পড়ালেখা শেষ করে সুচিত্রা সেন স্থানীয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগী ও মেধাবী না থাকলেও গান, নাটক, অভিনয় প্রিয় ও পছন্দের ছিল সূচিত্রা সেনের। পাবনা শহরের নানা অনুষ্ঠানে গান গাওয়া ও নাটক থিয়েটারে তিনি অভিনয়ে দক্ষতা দেখান।
উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সুচিত্রা সেন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ক’মাস আগে বাবা করুণাময় দাসগুপ্ত পাবনার বাড়ি-ঘর, চাকুরী সবকিছু ফেলে স্বপরিবারে ভারত চলে যান। কলকাতা যাবার বছর দু’য়েক পরেই সেখানকার বনেদি পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সাথে রমাদাশগুপ্তের বিয়ের পর নাম হয় সুচিত্রা সেন। আর বিয়ের পর স্বামীর পদবীতে রমাদাশগুপ্ত হয়ে যান রমা সেন। সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেনের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশেরই দক্ষিণ অঞ্চলে।
পাবনার উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রমা বনেদি পরিবারের বধু হয়ে ঘর সংসারের পাশাপাশি সিনেমায় অভিনয়ে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে “শেষ কোথায়” নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। অজ্ঞাত কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবি “সাত নম্বর কয়েদি” ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন একটানা বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেন। স্বামী দিবানাথ সেনের প্রবল আপত্তি থাকলেও সুচিত্রা সেন মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িয়ে রাখেন। ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। তারই একজন সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় এ ছবিতে অভিনয় করার পর ছবি মুক্তির সময় রমা নাম বদলে নাম দেন ‘সুচিত্রা সেন’। এরপর থেকেই কিশোরী বেলার বান্ধবিদের রমা বাবা-মায়ের দেওয়া নাম রমা দাশগুপ্ত থেকে স্বামীর পদবী নিয়ে রমা সেন সবশেষে স্বপ্নসুন্দরী সুচিত্রা সেন হয়ে যান। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও ৭টি হিন্দি মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি হয়ে বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন। ১৯৭৮ সালে উত্তম কুমার মারা গেলে সিনেমায় অভিনয় বন্ধ করে দেন।
১৯৬৩ সালে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন সিলভার প্রাইজ ফর বেষ্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ভারত সরকারও তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করেন। ২০০৫ সালে তাঁকে দাদা সাহেব ফলকে পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব রাখলে তিনি জনসমক্ষে আসতে চাননি বলে তা গ্রহন করেননি। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের র্স্বোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণ দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি দেবদাস ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন, যা ছিলো তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কোলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
সূচিত্রা সেনের অভিনীত চলচ্চিত্র নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে পাবনায় শুরু হয় সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব। সূভাষ দত্ত, কবরীসহ বহু নামী দাবী শিল্পী ঐ সময় পাবনায় আসেন। এর পর থেকে একে চিত্রনায়ক ফারুক, আলমগীর, নায়ক রাজ রাজ্জাক, নায়িকা সুজাতা, রোজিনা, চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, নায়ক উজ্জ্বল, নায়িকা দিতিসহ নবীন ও প্রবীণ নায়ক নায়িকারা এই উৎসবে আসেন। সর্বশেষ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পাবনা জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এবং সূচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সহায়তায় ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সূচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি আয়োজনে এই উৎসব পালন সূচিত্রা সেন ও পাবনার ভাবমুর্তিকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।
সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষর পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. নরেশ চন্দ্র মধু বলেন, সূচিত্রা সেনকে নিয়ে আমাদের আবেগের কমতি নেই। সবার সহযোগিতায় আমরা তার বাড়ী উদ্ধার করতে পেরেছি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় শিল্পকলা একাডেমির সহায়তার তার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পাবনার মেয়ে সূচিত্রা সেন আজীবন নতুন প্রজন্ম এবং বিশ্ববাসীর মনের মনি কোঠায় বেেঁচ থাকবেন।
মহানায়িকার মৃত্যুর পর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের গার্লস হোস্টলের নাম করা হয় সুচিত্রা সেন ছাত্রীনিবাস।
২০১৪ সালে তাঁর জন্মদিন ৬ এপ্রিল বাড়িটি সকলের জন্যে খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তা দেখভাল করে পাবনা জেলা প্রশাসন। এখানেই গড়ে উঠেছে ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মূল দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে সুচিত্রা সেনের কাট আউট। আর ডানদিকে কফি রঙে উজ্জ্বল মহানায়িকার আবক্ষ মূর্তি। তিনি কি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, রবীন্দ্রনাথের ‘ঊর্বশী’, নাকি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’? কবিকল্পনার মূর্ত প্রতীক পাবনার সুচিত্রা সেন। সাগরিকা, মল্লিকা, অর্চনা বা বিপাশার সাবলীল মহানায়িকা!
উঠোন শেষে সিঁড়ি-বারান্দা, তারপরেই মূল ঘর। সেখানে মহানায়িকা অভিনীত ছায়াছবির গানগুলি ভিডিওতে চলে সারাদিন। ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘এই পথ যদি শেষ না হয়’, ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে’ গানে মুখর থাকে সংগ্রহশালা। সঙ্গে মায়াবী চাহনি, নির্মল হাসি বা মধুমাখা আধো আধো কণ্ঠে অসাধারণ সব সংলাপ। ঘরগুলোর দেওয়াল জুড়ে ছোট বড় ফ্রেমে ধরা পড়েছে তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবি। কোনওটা পারিবারিক, কোনওটা বিশেষ অনুষ্ঠান, কোনওটা বা সিনেমার। মাঝে মাঝে ঝুলছে তাঁর পছন্দ-অপছন্দ এবং অনেক অজানা বিষয় নিয়ে লেখা একাধিক ফেস্টুন। কোনওটা বিয়ে, কোনওটা চলচ্চিত্র জগৎ, কোনওটা শোবার ঘর, কোনওটা বা মহানায়িকার আধ্যাত্নিক ভাবনা নিয়ে লেখা। সংগ্রহশালার ঘরগুলো দেখতে দেখতে নস্টালজিক হয়ে পড়বে যে কেউ। সুচিত্রা সেনের লিপে সিনেমার গান মুগ্ধ করবেই দর্শককে।