৩০ বছর বয়সী কৃষ্ণ চন্দ্র দাশের অসাধারণ একটি যাত্রায় মুগ্ধ চট্টগ্রামের আইন অঙ্গন। আইনজীবী হিসেবে তার যাত্রা কেবল শুরু, তবে এই শুরুটাই হয়ে গেছে ইতিহাস।
শত বছর ধরে যে হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যরা সেবক হিসেবে সমাজের চোখে ‘অস্পৃশ্য’ হয়ে আছে, সেই সম্প্রদায়ের প্রথম সদস্য হিসেবে আদালতে আইনি লড়াইয়ের যোগ্যতা অর্জন করেছেন তিনি।
তার এই সাফল্য হয়ে গেছে উদাহরণ; সেটি নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য, তেমনি চট্টগ্রামের আইন অঙ্গনের জন্যও।
আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর তাই কৃষ্ণের সংবর্ধনার আয়োজনে যোগ দিলেন গণ্যমান্য আইনজীবী আর বিচারকরা।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম আদালতে আয়োজনে জেলা ও দায়রা জজ ড. আজিজ আহমেদ ভূঁঞাসহ বিচারক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা গাউন পরিয়ে তাকে বরণ করে নেন।
বিচারক বলেন, “আইন অঙ্গনে হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্য কৃষ্ণ দাসের অন্তর্ভুক্ত হওয়া আনন্দের, গর্বের ও গৌরবের।”
কৃষ্ণ দাশকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আনন্দিত চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, “একাগ্রতা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অর্জিত কৃষ্ণের সাফল্য তার সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের জন্য উদ্দীপনা ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত হয়ে পথ দেখাবে।” বাবার আগ্রহে শিক্ষার পথে যাত্রা, মহিউদ্দিন চৌধুরীর বদান্যতা
শত শত বছর ধরে হরিজনদের পেশা ‘সেবক’। তবে চট্টগ্রামের বান্ডেল সেবক কলোনির কৃষ্ণ দাশের বাবা ঠিক করে রেখেছিলেন, সন্তানকে এই পথ মাড়াতে দেবেন না। কিন্তু এই যাত্রাটি সহজ ছিল না।
অদূরে পাথরঘাটা বাল্ডেল রোড এলাকায় সেই কলোনি। এখানেই কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস করছে হরিজনরা।
কৃষ্ণকে লেখাপড়া করানোর মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না পরিবারের। সেই কঠিন পথ পাড়ি দিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
কৃষ্ণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের হরিজন সম্প্রদায় ব্রিটিশ আমলে ভারত থেকে এখানে এসেছিল। আমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সবাই সেবক হিসেবে কাজ করেছেন।
“১৯৯৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর বান্ডেল সেবক কলোনিতেই আমার জন্ম। আমার বাবা চিরঞ্জীব দাসের স্বপ্ন ছিল আমাদের লেখাপড়া শেখাবেন। আমরা তিন ভাই, এক বোন। বোন সবার বড়। আমি দ্বিতীয়।”
পরিবারটির শিক্ষা গ্রহণের এই যাত্রাটি কৃষ্ণকে দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি। তার একদম ছোট ভাইটি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
বাবা চিরঞ্জীব দাস ছবি হয়ে গেছেন। তিনি কৃষ্ণের জীবনের অনুপ্রেরণা। মা ছায়া দাস এখনো তার জীবনের ছায়া
নিজের শিক্ষা জীবন সম্পর্কে কৃষ্ণ বলেন, “২০০৯ সালে আমি মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি আর ২০১২ সালে ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। তারপর বাবা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, আমি কী পড়ব, কীভাবে পড়ব।”
তার বাবা ছোট বেলায় বলতেন ছেলেকে ডিগ্রি পাস করাবেন। সিদ্ধান্ত নিতে না পারার পর একদিন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে গেলেন। বললেন, “আমার ছেলেকে পড়াতে চাই।”
কৃষ্ণের ভাষ্য, মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, “তোমার ছেলে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে লয়ে (আইন) পড়াও। তোমাদের হরিজন সম্প্রদায়ে একজন উকিল হোক।”
“সেই স্বপ্ন উনি (মহিউদ্দিন) দেখিয়েছিলেন। তিনি প্রিমিয়ারে পুরো খরচ দিলেন। মহিউদ্দিন স্যার যদি আমাকে ভর্তি করিয়ে না দিতেন, পুরো ফ্রিতে পড়ার সুযোগ না দিতেন তাহলে কখনোই আমার আইনজীবী হওয়া সম্ভব হত না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচও কম নয়”, বলেন কৃষ্ণ।
আইনে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর এবার বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাস করে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
কৃষ্ণের বাবা চিরঞ্জীব দাস ও মা ছায়া দাস দম্পতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সান্নিধ্যে যেতে পেরেছিলেন, কারণ তারা সিটি করপোরেশনে সেবক পদে কর্মরত ছিলেন। আর হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য মহিউদ্দিন সব সময় ছিলেন উদারহস্ত।
চট্টগ্রামে হরিজনদের জীবন মান উন্নয়নে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবদান ছিল। কৃষ্ণ যেন বিনা মূল্যে উচ্চ শিক্ষা নিতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র
অতীতে হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে বলা হত মেথর। মহিউদ্দিন চৌধুরই তাদেরকে মর্যাদা দিয়ে নাম দেন ‘সেবক’।
২০১৬ সালে কৃষ্ণ দাস বিয়ে করেন দীপিকা দাসকে। মহিউদ্দিন চৌধুরী তার জীবদ্দশায় হরিজন সম্প্রদায়ের বিয়ে পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা করতেন। বৌভাত অনুষ্ঠানগুলো চশমা হিলে বেশ ঘটা করেই হত।
২০১৬ সালে বান্ডেল কলোনিতে কৃষ্ণের বিয়েতেও এসেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এই দম্পতির এখন দুই সন্তান। তাদের নিয়ে বান্ডেল কলোনিতেই আছেন কৃষ্ণ।
কৃষ্ণের এই সাফল্য বাবা দেখে যেতে পারেননি। ২০২০ সালে তিনি মারা যান। তবে ছেলের স্নাতক পাসের কথা জেনে গেছেন।
“আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার মায়ের কষ্ট সার্থক হয়েছে”, একই সঙ্গে গর্ব ও আক্ষেপ ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে।
আদালতে পাঁচ বছর ধরেই
এবার তালিকাভুক্ত হলেও কৃষ্ণ আদালতে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছেন ২০১৮ সাল থেকেই।
তিনি বলেন, “যখন আমি এলএলবি পড়ছি তখন থেকে অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী স্যার খোঁজখবর নিতেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি ভাল করে আইন পড়। তোমার জন্য আমার চেম্বারের দরজা সব সময় খোলা।’
“২০১৮ সালে আমি পড়া শেষ করি। এরপরই উনার চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে যোগ দিই।”
২০১৪ সালে তার বাবা চিরঞ্জীব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন মা ছায়া দাসের চাকরির বেতন আর তার টিউশনির টাকায় চলত সংসার। এলএলবিতে পড়ার সময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজও করেছেন তিনি।
‘জাতের বিভাজন মানুষের কাজ নয়’
কৃষ্ণকে সংবর্ধনার আয়োজনে চট্টগ্রামের জেলা জজ ড. আজিজ আহমেদ ভূঁঞা বলেন, “মানুষের মধ্যে কোনো প্রকার ভেদাভেদ বা উঁচু জাত নীচু জাত বলে বিভাজন করা মানুষের কাজ না।”
তিনি বলেন, “সমাজের অবহেলিত শ্রেণির সন্তান হয়ে কৃষ্ণ দাশ যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তার এই একাগ্রতা, চিন্তা শক্তি এবং কঠোর পরিশ্রম এই সফলতা এনে দিয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, নিজের অবস্থান সুদৃঢ় রেখেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, কৃষ্ণ তার দৃষ্টান্ত।
“তিনি আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তা আনন্দের, গর্বের, গৌরবের। বিচারক হিসেবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি, আমার কার্যকালে বাংলাদেশের প্রথম হরিজন সম্প্রদায়ের থেকে কৃষ্ণ আইনজীবী হয়েছেন।”
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ন জেলা জজ খায়রুল আমিন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ইব্রাহিম খলিলসহ আইন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা পিপি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, “কৃষ্ণকে আগে থেকেই চিনতাম। সে পড়াশোনায় ভালো। তার একাগ্রতা ছিল। এ সম্প্রদায় থেকে তার এগিয়ে চলা অন্যদেরও উৎসাহ জোগাবে।
“আশা করব সে কর্মজীবনে নিজেকে একজন প্রকৃত আইনের সেবক হয়ে বিচারপ্রার্থী জনগোষ্ঠীকে ন্যায়বিচার দিতে কঠোর পরিশ্রম করবে। তার সফলতা হরিজন সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করেছে, তার এই সফলতার জন্য তাকে অভিনন্দন।”
নিজ সম্প্রদায়ের পাশে কৃষ্ণ
তিনি বলেন, “আমি হয়ত উকিল হয়েছি। কিন্তু আমার ওরা আমার পরিবার, আমার সমাজ। তাদের ছেড়ে আমি কোথায় যাব?
“আমাদের সমাজে অনেকেই এখন লেখাপড়া করছে। কেউ গ্র্যাজুয়েশন করছে। কেউ উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে। বাবা-মায়েরা কষ্ট করে হলেও সন্তানদের পড়াচ্ছে। আমার সমাজের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমি চাই তাদের জন্য কিছু করতে।”
সেবক কলোনির প্রধান মায়াদিন সরদার বলেন, “কৃষ্ণকে আমরা সমাজের পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার সম্মানিত করেছি। সে আমাদের গর্ব। আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম আইনজীবী।”