হস্তক্ষেপ করলে প্রয়োজনে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে, নিয়োগ করা হবে প্রশাসক
অগ্রসর রিপোর্ট : আর্থিক অনিয়ম,ঋন কেলেংকারি, শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধনের পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে দুর্বল ১০টি ব্যাংক চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংকের জন্য বিশেষ প্যাকেজ তৈরী হচ্ছে যা সংশ্লিষ্ট পষর্দকে কঠোর ভাবে পরিপালন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স রুমে আয়োজিত মিট দ্য প্রেসে এ কথা জানান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
মিট দ্য প্রেসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়, ঋণ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত মাস্টার সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এ সার্কুলারে বর্ণিত শর্ত মোতাবেক ব্যাংকগুলো উপরোক্ত বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, যা আগে অনেকটা অস্বচ্ছ এবং অসমভাবে করা হতো।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকসমূহকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে চারটি চলক যেমন-শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধনের পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশনিংয়ের পরিমাণ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে দুর্বল ১০টি ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে।
চিহ্নিত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তাদের সমস্যা সমাধানকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক ওয়ান-টু-ওয়ান ভিত্তিতে আলোচনা কার্যক্রম শুরু করছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো তিন বছর মেয়াদি বিজনেস প্ল্যান দেবে, যার ক্রম অগ্রগতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ করবেন।
গভর্নর জানান, আমি দুর্বল ব্যাংকগুলোর নাম বলতে চাই না। তবে পত্রপত্রিকায় ইতোমধ্যে নাম এসেছে। আমাদের লক্ষ্য ব্যাংকগুলোকে উন্নতির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা।
তিনি বলেন, দুর্বল ১০টি ব্যাংকের মধ্যে প্রথমটির (ন্যাশনাল ব্যাংক) সঙ্গে আলোচনায় বলেছি, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর আজ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয়বার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন নতুন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুর্বল ১০ টি ব্যাংকের মধ্যে ইতোমধ্যে দুইটি ব্যাংকের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। একটি বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল)। অপরটি বিদেশী ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। ব্যাংক দুইটির খেলাপি ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে বলে ওই সূত্র জানায়।
সূত্র জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) অনিয়ম সামাল দিতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে ব্যাংকটির পরিচালকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দুই দিন আলোচনায় বসেছেন। এ সময় তিনি ব্যাংকটি পরিচালনায় শক্ত ভূমিকা পালনের জন্য পরিচালকদের নির্দেশনা দেন।
ঐ আলোচনায় গভর্ণর জানিয়ে দিয়েছেন, পরিচালকেরা এনবিএলের কার্যক্রমে অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে প্রয়োজনে এর পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে। নিয়োগ করা হবে প্রশাসক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ব্যাংক পরিচালনা করতে হবে। তাঁর বক্তব্যে, চুক্তি করে ব্যাংকটিকে সঠিক পথে পরিচালনার ইঙ্গিতও ছিল।
জানা গেছে, বর্তমান গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করার পর ন্যাশনালসহ কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৮ জুলাই এনবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দেয়। চিঠিতে এনবিএলের সার্বিক আর্থিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা মূল্যায়নের জন্য ২৪ জুলাই এক পর্যালোচনা সভায় যোগ দিতে বলা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই গত ২৪ জুলাই দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকে যান ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নাইমুজ্জামান ভুঁইয়া, পরিচালক খলিলুর রহমান ও মোয়াজ্জেম হোসেন এবং এমডি মেহমুদ হোসেন। সূত্র জানায়, পরদিন ২৫ জুলাই বেলা ১১টায় ব্যাংকটির পরিচালক রন হক সিকদার ও এমডি মেহমুদ হোসেন গভর্নরের সঙ্গে সভা করেন। এতে রন হক সিকদারের সঙ্গে একজন বিদেশি পরামর্শকও যোগ দেন।
সভায় গভর্নর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহীকে জানিয়ে দেন, নিয়মের মধ্যে থেকেই ব্যাংক চালাতে হবে। ইতিমধ্যে ব্যাংকটির যে খারাপ অবস্থা হয়েছে, তা সামাল দিতে তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা চুক্তি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে তিন বছরে কীভাবে উন্নয়ন করা যাবে, তা উল্লেখ থাকবে। এ চুক্তিতে ব্যাংকটির সব পরিচালককে সই করতে হবে। ২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কড়া নজরদারি সত্বেও আবারো আর্থিক অনিয়ম ও ঋন কেলেংকারির মতো ঘটনা ঘটাতে চেষ্টা করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পষর্দ। এসব কারনে ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পষর্দের উপর চরম ক্ষুব্দ হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদেশী দুর্বল ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এর সাথেও আলোচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানকেও একই বার্তা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পরপরই সমস্যাকবলিত ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের নিবিড় তদারকির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ মোতাবেক অধিক সমস্যা কবলিত ১০টি ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুইটি ব্যাংকের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। আরো ৮টি ব্যাংকের সাথে আলোচনা করা হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের কাছ থেকে কর্মসূচি নেয়া হবে। সে অনুযায়ী তাদের সাথে চুক্তি করা হবে। ওই চুক্তি মোতাবেক ব্যাংকিং পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তা নিবিড় তদারকি করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ও তাদের দেয়া কর্মসূচি পরিপালনে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দেয়া হবে।
বৃহস্পতিবার মিট দ্য প্রেসে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বস, নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম ও সহকারী মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।