খায়রুল আলম
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহতের পর ওই বছরের ১১ অক্টোবর সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠনগুলো কমিটি গঠনের পাশাপাশি রাজনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বলে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ জুলাই বুয়েটে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধেও।
১. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাচ্ছে ছাত্রশিবির ও হিযবুত তাহরীর—এমন দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ শিক্ষার্থী। তারা বলছেন, ‘একটি অন্ধকার সংগঠন’র ইন্ধনে বুয়েটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শনিবার (৩০ মার্চ) বিকেলে এ সংবাদ করেন ওই শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা নিজেরা ‘কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে’ সংযুক্ত নন বলে দাবি করেন।
নিজেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া এই পাঁচ শিক্ষার্থীর দাবি—‘(বুয়েটে) মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হয়ে যিনিই কথা বলছেন, তাকেই ‘ছাত্রলীগ’ ট্যাগ দিয়ে বারবার অত্যাচার করা হচ্ছে।’
এদের মধ্যে একজন তানভীর মাহমুদ লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। বক্তব্যে বলা হয়, ‘২০২৩ সালের জুলাইয়ে সুনামগঞ্জের হাওরে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অভিযোগে বুয়েটের প্রাক্তন এবং বর্তমান ৩৪ জন শিক্ষার্থী গ্রেফতার হন। তাদের নামে আদালতে মামলা চলমান এবং সবাই জামিনে আছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করি। এই মানববন্ধন করার পর আমাদের চিহ্নিত করে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং জবাবদিহি চাওয়া হয়। বিভিন্ন হলের কক্ষে কক্ষে রাত ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ডেকে জবাবদিহি চাওয়া হয়। এমনকি মানববন্ধনকে একটি অপরাধের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের হল থেকে বের করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়।’
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘বুয়েটের অভ্যন্তরীণ ফেসবুক গ্রুপগুলোতে আমাদের পক্ষে কেউ নিজের কোনো মতামত রাখতে গেলে তাকে বুলিং এবং নানা ধরনের হুমকির শিকার হতে হয়। আমাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক কিংবা পরিচয় থাকায় অনেককেই কটাক্ষের স্বীকার হতে হয়। যে কারোরই পারিবারিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেই বা পরিচয় থাকলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়; পরিবার নিয়েও অনলাইন-অফলাইনে অশালীন মন্তব্য করা হয়।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের মতো গুটিকয়েক ছেলের বিরুদ্ধে কারা এবং কাদের ইন্ধনে এসব হচ্ছে, তা একটু ভেবে দেখার সময় হয়েছে। মিথ্যাচার করে আমাদের দোষী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী।’
অন্য এক শিক্ষার্থী আশিক আলম বলেন, ‘ক্যাম্পাসের কিছু ঘটনা এবং আমাদের ওপর একের পর এক আক্রমণ প্রমাণ করে দেয় যে ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েট ক্যাম্পাসে এখন প্রকাশ্যেই হিযবুত তাহরীর তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এই নিষিদ্ধ সংগঠন তাদের স্বার্থ হাসিল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি আবেগ নিয়ে। বুয়েটে আবরার ফাহাদ ভাইয়ের সঙ্গে খুব খারাপ একটি ঘটনা ঘটেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।’
হিযবুত তাহরীর ও ছাত্রশিবির বুয়েটে কার্যক্রম চালাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হিযবুত তাহরীর ও শিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আবেগকে পুঁজি করে প্রকাশ্যেই নিজেদের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনেক শিক্ষার্থী থাকলেও ভয়ে ও হুমকিতে আসতে পারছেন না। আরও ২০-২৫ জন এখানে আসতে চাইলেও তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’
যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে তাহলে অভিযোগগুলোর গভীরতা অত্যন্ত সুদুরপ্রসারী।
২. ২০২২ সালে জাতীয় শোক দিবসের ঠিক আগে জাতির জনক ও তার পরিবারের সদস্যদের ৪৭তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একদল শিক্ষার্থীর আপত্তি তোলা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
প্রশ্ন ওঠেছিলো, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকার পরেও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীর ও যুদ্ধাপরাধীদের দোসর শিবিরের তৎপরতা নিয়ে কথিত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোন কথা নেই কেন? কেন অল্প সময়ের নোটিসে জাতির জনকের জন্য দোয়া অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতে জড়ো হতে পারলেও, শোক দিবসের কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে না এ স্বঘোষিত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা? প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ধুয়া তুলে কৌশলে মৌলবাদী রাজনীতি বুয়েট দখল করছে না তো?
৩.
ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে ছাত্রলীগ কর্মী আরিফ রায়হান দীপকে বর্বরোচিতভাবে মাথায় ও পিঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগ ওঠে, পরে তিনি মারা যান। এছাড়া, প্রগতিশীল সংগঠনগুলো যখন নিষ্ক্রিয় তখন অনেকটা প্রকাশ্যেই সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি বুয়েটকে কেন্দ্র করে পোস্টারিং করে সংগঠনটি। নিষিদ্ধ এ সংগঠনটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা সক্রিয় থেকে কর্মী সংগ্রহ ও প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ করছে বলেও বিভিন্ন সময় খবর প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন উঠেছে, জাতির জনক ও তার পরিবারের জন্য আয়োজিত দোয়া অনুষ্ঠানের বিরোধিতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যারা জড়ো হয়েছেন, তারা কেন নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনের বিরোধিতায় সরব হন না? কেন তারা নিজেরা শোক দিবসের কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করেন না? আর তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যারা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি করছেন তারা সাধারণ কি-না, এ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে। সন্দেহ, রাজনীতি নিষিদ্ধের আড়ালে মৌলবাদী রাজনীতি কৌশলে বুয়েটের দখল নিচ্ছে।
৪. গত ২৮ তারিখ রাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন তার রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ে বুয়েটের একটি সেমিনার রুমে কর্মসূচির আয়োজন করেন—এমন অভিযোগ এনে শুক্রবার দুপুর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার (২৯ মার্চ) দুপুর থেকে আন্দোলনে নামে বুয়েট শিক্ষার্থীরা৷ এসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে ছয়দফা দাবি জানায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সাধারণ ছাত্রের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার গভীররাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দপ্তর সম্পাদকসহ অনেকেই বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বুয়েটে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে তারা নতুন করে রাজনীতি শুরুর পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন। তবে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর পক্ষে থেকে বুয়েট শিক্ষার্থীদের পাঠানো জিহাদি ইমেইল নিয়ে নিশ্চুপ সাধারণ ছাত্রের ব্যানারে আন্দোলনরত এই শিক্ষার্থীরা।
বুয়েটে নীরবে জিহাদি কার্যক্রম বা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে হিবুজত তাহরীর। সম্প্রতি এই নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনটির পক্ষ থেকে বুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক আউটলুক ইমেইলে পাঠানো হয়েছে হিযবুত তাহরীরের জিহাদি ইমেইল।
অন্যদিকে ২০২৩ সালের ৩০ জুলাই সরকারবিরোধী নাশকতার পরিকল্পনা করার অভিযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২৪ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। এমনকি গ্রেপ্তারকৃতরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত বলেও জানিয়েছিল পুলিশ। এ সকল ঘটনা নিয়ে আলোচনা থাকলেও আলোচনা নেই বুয়েটে। জামিনে তারা বের হয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাশাপাশি তারা অঘোষিত ভাবে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইন্ধন যোগাচ্ছে ও যোগানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ।
হিজবুত তাহরীর এ ধরনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় শিক্ষার্থীরা যতটা না শঙ্কিত তার থেকে বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। তাদের ভাষ্যমতে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ না করা হলে খুব শিগগিরই জঙ্গি আস্তানায় পরিণত হবে বুয়েট। এমনকি আরও শিক্ষার্থীদের আবরার ফাহাদের মত পরিণতি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। কারণ অন্য কোন রাজনৈতিক সংগঠন না থাকায় ক্যাম্পাসে অচিরেই হতে পারে হিজবুত তাহরীর একছত্র আধিপত্য।
৫. এর আগে ২০০২ সালে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হন বুয়েট শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার সনি। ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও ২০২০ সালে বুয়েটে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করেছিল বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল৷ ছাত্রদল বলছে, ছাত্ররাজনীতি না থাকলে বুয়েটে ‘উগ্রবাদের’ উত্থান ঘটার আশঙ্কা রয়েছে৷ তাই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত তারা মানে না৷
এদেশে ছাত্ররাজনীতির চরিত্র বদলেছে জাতীয় রাজনীতির হাত ধরে। গত কয়েক দশক ধরে যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, সেই দলের ছাত্র সংগঠন ফ্রাঙ্কেস্টাইনে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াত সব সময় যাবতীয় কুকর্মে ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেছে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার পর যে পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টে যাবে-তেমনটা আশা করা ভুল। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। ছাত্র রাজনীতিই বন্ধ করে দেওয়া হলে অপশক্তিই সুবিধা পাবে। ছাত্র রাজনীতিকে তার গৌরবের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিসর নিশ্চিত করার দাবি না তুলে যদি ছাত্র রাজনীতিকেই নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে ভিন্ন নামে ভিন্ন অরাজনৈতিক সাংগঠনিক কাঠামোতে সন্ত্রাসী তৎপরতা সংগঠনের সুযোগ যেমন থেকে যাবে, সেই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির যে ধারাটি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পক্ষে লড়াই করে, তার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। ফলে ওইসব শক্তিই লাভবান হবে, যাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ হুমকিস্বরূপ।