সাব্বির মাহমুদ রাবাত
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সরকার সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করে। ২৫ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানী সেনা ও তাদের সহযোগী জামায়াত, মুসলিম লীগ, বিহারীরা মিলে বাঙালী হিন্দু-মুসলিমদের জোর করে ধরে নিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে বিমানবন্দরের কাজ করিয়ে নিতে থাকে। এ অবস্থা চলতে থাকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।
১ জুন বিহারী সম্প্রদায় নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে মারোয়ারি পট্টি থেকে ১৮৫ জন মারোয়ারিকে বন্দী করে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। বিহারী সম্প্রদায় মারোয়ারিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছে অভিযোগ করে বলে, ‘মারোয়ারিরা ভারতের দালাল।’ বিহারী সম্প্রদায়ের কথা শুনে পাকিস্তানী সেনারা হিন্দু মারোয়ারিদের অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যা করতে থাকে। পাকিস্তানী সৈন্য ও বিহারীদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষার কোন উপায় ছিল না। পাকিস্তানী সেনারা ৬ জুন বিহারীদের সহযোগিতায় সৈয়দপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু মারোয়ারিদের ধরে এনে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখে।
পাকিস্তানী সেনারা সৈয়দপুরের হিন্দু সম্প্রদায়কে ভারতে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই মোতাবেত মারোয়ারি সম্প্রদায় আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সকাল ৫টায় সৈয়দপুরের মারোয়ারিপট্টি ও অন্যান্য এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তানী বাহিনী এবং বিহারীদের আশ^াসে তাদেরই তত্ত্বাবধানে আত্মরক্ষার জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়।
পাকিস্তানী সেনারা সৈয়দপুর শহর থেকে সবাইকে ট্রেনে উঠিয়ে চিলাহাটির দিকে যেতে থাকে। ট্রেনের চারটি বগিতে সবাইকে তোলা হয়। প্রথম দুটি বগিতে পুরুষদের তোলা হয় এবং পরের দুই বগিতে নারী ও শিশুদের তোলা হয়। গোলাহাট রেলকারখানার শেষ মাথায় হঠাৎ করে ট্রেনটি থেমে যায়। ট্রেনটি থামার সঙ্গে সঙ্গে একজন যাত্রীকে জানালা দিয়ে বের করে তরবারি দিয়ে মাথাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়।
পুলিশের পোশাকে অবাঙালী বিহারী রামদা, চাপাটি নিয়ে ট্রেনে উঠে পরে। এদের মধ্যে কয়েকজন বলতে থাকে, ‘মালাউনদের খতম করব এবার।’ এরপর তারা সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে ধরে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে।
এই চিত্র দেখে তপন কুমার প্রথমে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা তাকে ধরে ফেলে। তখন তপন সৈন্যদের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। তপন কুমার দাস সেই দিনের স্মৃতিচারণে বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনারা ১৩ জুন আনুমানিক সকাল ৫টায় ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ৪টি বগিতে আমাদের তোলে। ট্রেনে ওঠার পর পাকিস্তানি সেনাদের বোঝাতে অসুবিধা হলো না, এই দিন আমাদের শেষ দিন। সে সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ করে ট্রেন এসে ফাঁকা স্থানে দাঁড়ায়। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা যাত্রীদের কিল-ঘুষি-লাথি মেরে ট্রেন থেকে নামাতে থাকে। ট্রেনের যাত্রীদের ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করতে শুরু করে। যাত্রীদের অনেকে ধারাল অস্ত্রের আঘাত সইতে না পেড়ে গুলি করে মারার জন্য অনুরোধ করে। পাকিস্তানী সেনাদের জবাব ছিল গুলির অনেক দাম। একে একে বগি থেকে নামিয়ে তলোয়ার দিয়ে কাটতে শুরু করে। ট্রেনের একপাশে যখন গণহত্যা চলছিল সে সময় অন্য পাশ থেকে আমিসহ কয়েক যুবক দশ-পনেরো ফুট নিচে লাফ দিয়ে পড়ি। তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা বৃষ্টির মধ্যে দৌড় দিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করি। পাকিস্তানী সেনারা পেছন থেকে আমাদের গুলি করতে থাকে। আমরা কয়েকজন পালিয়ে নিজেদের রক্ষা করলেও ওই ট্রেনের প্রায় ৪১৩ জন যাত্রী শহীদ হন।’
ট্রেনের দ্বিতীয় বগি থেকে পঞ্চাশ জনের মতো জীবনবাজি রেখে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সেনারা তাদের লাফিয়ে পড়তে দেখে পেছন থেকে ব্রাশফায়ার করতে থাকে। ব্রাশ ফায়ারের হাত থেকে তেইশজনের মতো বেঁচে যান। বাকি সবাইকে পাকিস্তানী সেনারা ট্রেন থেকে নামিয়ে বিহারীদের সহযোগিতায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে।
পাকিস্তানী সেনারা শিশুদের আকাশে ছুড়ে তরবারির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে দ্বিখ-িত করে হত্যা করে। অনেক শিশুকে পাকিস্তানী সেনারা এক পা দিয়ে অন্য পা টেনে ছিঁড়ে ফেলে হত্যা করেছে। ওই দিনের গণহত্যায় নারী ও শিশুরা বেশি শহীদ হয়েছিল।
এই গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট’ প্রকাশিত আহম্মেদ শরীফের গবেষণাগ্রন্থ ‘গোলাহাট গণহত্যা’ নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায়। এই গ্রন্থমালার সম্পাদক ‘মুনতাসীর মামুন’ ও সহযোগী সম্পাদক ‘মামুন সিদ্দিকী’। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের গণহত্যা নিয়ে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট’ ৭০টি নির্ঘন্ট গ্রন্থমালা প্রকাশিত করেছে।
লেখক : আর্কিভিস্ট, গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা