ড. অণিমা রায়
সংগীতের একার যাত্রাপথে অনেকের কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি বটে। আমাকে শিল্পী বলে মেনে নিতে অনেকেই দ্বিধায় থাকতেন কিন্তু বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে সাদি স্যার শিল্পী ও উপস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে স্যার আমাকে পরিচিতি পর্বে সহশিল্পী বলে পরিচয় করিয়ে দেন। সেইদিন সেই সহশিল্পী সম্বোধনে গর্বে আমার হৃদয়টি পূর্ণ হয়ে ওঠে।
অনেকের দেওয়া অনেক কষ্ট আমার বিলীন হয়ে যায় যখন সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহ স্যারের মতো মানুষ আমাকে তার সহশিল্পী বলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আরও ভালো গাইতে হবে। তা না হলে স্যারের কথাটির সম্মান রক্ষা করতে পারব না। মাঝে মাঝে স্যারের সঙ্গে আমার ফোনে একটু একটু কথা হতো। আমার গানের দুর্বল দিকগুলো মাঝে মাঝে ফোনে বলতেন। কিন্তু সবার সামনে আবার প্রশংসা করতেন।
এই আমাদের সাদি স্যার। এরপর বহু অনুষ্ঠানে, বহু লাইভে, আমার প্রতিটি সিঁড়ির মোড়ক উন্মোচনে, আমার ছাত্রীর সিঁড়ির মোড়ক উন্মোচনে, কোনো প্রতিযোগিতায় বিচারকার্যে, রবীন্দ্রপ্রয়াণ-জন্মদিনের অনুষ্ঠানে, পয়লা বৈশাখের নানা আয়োজনে, সাদি স্যারের সঙ্গে পাশাপাশি বসার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ওই সময়ের মধ্যেই কত কথা কত গল্প গানের ফাঁকে ফাঁকে। রবীন্দ্রগানের কোনো তত্ত্বের জন্য আকস্মিক আটকে গেলে একমাত্র ভরসা সাদি মহম¥দ স্যার।
বিটিভির অনুষ্ঠান ‘গানের ঝরণাতলায়’সাদি স্যার উপস্থাপনা ও গ্রন্থনা করেন অনেক বছর যাবত। ওই অনুষ্ঠানে গাইতে স্যার প্রায় কল দিতেন। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখাটাও সেই ‘গানের ঝরণাতলায়’অনুষ্ঠানের শূটিং-এ স্যারের পৈত্রিক বাড়ি বসিলাতে। বাড়িটির নামটাও খুব সুন্দর ‘পরম্পরা’। ফখরুদ্দিনের এক বিশেষ বাবুর্চিকে দিয়ে সেদিন স্যার সবার জন্য কাচ্চি রান্না করে আনিয়েছিলেন।
আমি মনে মনে ভাবলাম স্যার কেমন মানুষ! একে তো নিজের বাড়ি দিচ্ছে শূটিং এর জন্য, আবার সবার জন্য কাচ্চি রান্না করিয়ে আনছেন বিশেষ বাবুর্চি দিয়ে। পৌঁছেই স্যারকে প্রণাম করলাম। এই একজনই মানুষ যাকে প্রণাম করতে আমার এত ভালোলাগে।
স্যারকে খালাম্মার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেই স্যার বললেন, ‘মায়ের বয়স হয়েছিল। কিন্তু আমার বড় বোনটাও চলে গেছে অণিমা তুমি কি জান?’ আমি বললাম জি স্যার আমি শুনেছিলাম। একটু নীরবতা, তারপর স্যার, ‘কাচ্চি না খেয়ে যেও না কিন্তু’। আমি বললাম, স্যার আমি হাতে সময় নিয়ে এসেছি। অন্যরা গান করছে আর আমি স্যারের সঙ্গে গান ধরার লোভে রয়ে গেলাম। বাকি শিল্পীরা কাজ সেরে প্রায় সবাই চলে গেলেন। ততক্ষণে কাচ্চি চলে এলো! সেদিন স্যার অনেক গল্প করলেন তার কক্ষে জানালার পাশে বসে।
তার বাবার মৃত্যুঘটনা বর্ণনা করলেন অনেকটা কোনো প্রশ্ন না করতেই। স্যার একটু উচাটন সেদিন। মনে হলো স্যারের মন খারাপ। কিন্তু কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সাহস আমার নেই স্যারকে। কোনোদিন ছিলও না। শুধু হ্যাঁ বা না কোনো কিছু না বলে স্যারের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলাম। চারপাশের হতাশা-গ্লানির কথা, অতৃপ্তির কথা, অপ্রাপ্তির কথা, পক্ষপাতিত্বের কথা! আমি বললাম আমার কি হবে স্যার! স্যার বললেন কিছু হবে না, মন খারাপ লাগলে আমাকে বলবে।
আর যেভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছো তাই করবে। স্যার থাকতে আমার যে সত্যিই কোনো চিন্তা নেই তা আমি জানতাম। আমার গানের শূটিং শেষ করে খেতে বসব সবাই। বাকি যারা শিল্পী, প্রায় চলে গেছেন। রয়ে গেছি কেবল আমি আর স্যার। আরও একজন ছিলেন, আমি তার নামটা জানতাম না। উনি খাবেন না বললেন, তাই আমরা খেতে গেলাম। স্যার আমি পাশাপাশি বসে খেলাম। সঙ্গে বিটিভি ইউনিটের অনেকেই এক টেবিলে। স্যার কত আদর করে সবাইকে খাওয়ালেন।
আমার ড্রাইভার খেয়েছে কিনা তারও খোঁজ নিলেন। ছবি তুলতে চাইলাম, স্যার বাইরে এলেন। সবার সঙ্গে ছবি তুললেন। কিন্তু কোথায় যে স্যার, থেকেও নেই। মনে হচ্ছিল উনি অনেক ভাগ করতে চাইছেন সবার সঙ্গে, কিন্তু হেরে যাচ্ছেন বারবার। স্যার উপরে উঠে গেলেন। আমার আরও একটু শূটিং এর কাজ বাকি ছিল তা শেষ করে আমি চলে এলাম। খাওয়ার টেবিলে স্যারকে বললাম স্যার, ‘পরের শূটিংটাতে আমার বাগানবাড়ি ‘পুনশ্চ’তে করেন স্যার। কিন্তু আপনাকে থাকতে হবে সেদিন।’
স্যার বললেন, ঠিক আছে একটা পর্বের শূটিং সেখানে করবেন। এবং স্যার থাকবেন। আমি তানভীরের নতুন বইটা স্যারকে দিলাম। স্যার একটি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠালেন তানভীরের বই হাতে নিয়ে। সেই স্যারের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪।
সাদি মহম্মদ স্যারের সঙ্গে আমার যত সুখস্মৃতি এই জীবনে হয়তো আমার আর কোনো গুরুশিষ্য সম্পর্কে তা নেই। কারণ স্যার একজন শিক্ষক হয়েও সাধারণ ছাত্রছাত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছেন সারাজীবন। তার ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরির জন্য কত যে সুপারিশ করেছেন কত জায়গায়। সুপারিশের পরে চাকরি না হলে শিশুর মতো মন খারাপ করতেন। এত বিশাল মাপের শিল্পী সাদি মহম্মদের হৃদয়ে বাস করত একজন সত্যিকারের পিতা।
ক্ষণে ক্ষণে অভিমান করা, কারও কোনো নেতিবাচক আচরণে সহজেই কষ্ট পাওয়া। তবে তাকে খুশি করাও ছিল ততটাই সহজ। একটু ভালো গান গাইলেই স্যার খুশি। স্যারের গান গাওয়া বা কোনো অনুষ্ঠানে সবাই প্রশংসা করলেই স্যার খুশি! কেমন অদ্ভুত মানুষ, এই যুগের সঙ্গে একেবারে বেমানান। তাই হয়তো সময়ের সঙ্গে তিনি আড়ি নিয়েছেন। যে পৃথিবীতে অব্যক্ত বাণীর ভাষা কেউ বোঝে না, কেউ বুঝতে চায় না, সেই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সঙ্গে তিনি আড়ি নিয়েছেন!
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়