মোরসালিন মিজান
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সংঘটিত গণহত্যার খবর দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। ২৭ মার্চ থেকে খবরটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে। অবরুদ্ধ সময়ে সংগ্রহ করা খবরের প্রাথমিক সূত্র ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া বার্তা। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে পাকিস্তানিদের বর্বর আক্রমণের খবর সবাইকে জানান বাঙালির মহান নেতা। সেই বার্তাই লুফে নিয়েছিল পৃথিবীর বিখ্যাত সংবাদ সংস্থাগুলো।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত সংবাদপত্র এসব তথ্য তুলে ধরে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বেশ কিছু ইংরেজি দৈনিক সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশী গবেষক ড. ফিরোজ মাহমুদ। তার সংগ্রহ ঘেঁটে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান সূত্র করে গণহত্যার খবর প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়।
সে সময়ের পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ২৫ মার্চ রাত ১১টায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ শুরুর সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বিদেশী সাংবাদিকদের। ২৫ মার্চ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের অতিথির তালিকায় সায়মন ড্রিং ছাড়াও ৩৫ বিদেশী সাংবাদিকের নাম ছিল। এই ৩৫ জনের সবাই হোটেলের বাইরে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি চান।
কিন্তু অনুমতি না পেয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তারা। সাংবাদিকদের ঠেকাতে হোটেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক মেজর তাদের গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। বলেন, ‘ইট ইজ গোয়িং টু বি টু ব্লাডি। বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমরা আমাদের লোকদের যদি গুলি করতে পারি, আপনাদের ওপরও গুলি করতে পারব।’
এ অবস্থায় হোটেলের ভেতরে অবস্থান করতে বাধ্য হন তারা। পরদিন ২৭ মার্চ সকালে বাংলাদেশ ছাড়া করতে সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিমানবন্দরে। সেখানে প্রত্যেককে বিবস্ত্র করে তল্লাশি চালানো হয়। সাংবাদিকদের ক্যামেরা, ফিল্ম, টাইপ রাইটার, নোটবইসহ সংবাদ লেখার প্রয়োজনীয় সব উপকরণ কেড়ে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় করাচীতে। সেখান থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের কেউ কেউ ব্যাঙ্ককে যান। কেউ কেউ যান ভারতের বোম্বেতে।
দি নিউইয়র্ক টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক সিডনি এইচ শ্যানবার্গ বোম্বেতে বসে নিজের প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে পাকিস্তানি সৈন্যদের অতর্কিতে আক্রমণ এবং সমগ্র ঢাকা নগরীতে তাদের হত্যাকা-ের বিবরণ দেন। প্রতিবেদনটি তার পত্রিকায় ২৮ মার্চ ছাপা হয়।
এদিকে আরেকটি তথ্য বলছে, ২৫ মার্চ রাতে অন্য একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন অ্যাসোসিয়েট প্রেসের রিপোর্টার আরনল্ড জেটলিন এবং আলোকচিত্রী মিশেল লরেন্ট। দুজনই পাকিস্তানি বাহিনীর চোখ এড়িয়ে গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহ করেন। ছবি তোলেন। তাদের পাঠানো খবর প্রকাশিত হয় ২৯ মার্চ।
এসব খবর বিশ্লেষণ করে গবেষক ড. ফিরোজ মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ২৫ মার্চ রাত ১২টার আগে ও পরে নিজের মোট তিনটি ঘোষণা গোপন তিন রেডিওতে রেকর্ড করেন বঙ্গবন্ধু। টেলিফোনে স্বকণ্ঠে ওই সব ঘোষণা রেকর্ড করেন দূরদর্শী নেতা। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণায় ছিল গণহত্যার তথ্য। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বোঝার সুবিধার্থে ইংরেজিতে ঘোষণা দেন তিনি। ঘোষণাটির বাংলা অনুবাদ এ রকমÑ ‘পাকিস্তান বাহিনী আকস্মিকভাবে ঢাকার পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি এবং রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনে আক্রমণ চালিয়েছে এবং নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করছে।’
গণহত্যার এই খবর জানানোর পাশাপাশি প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা জানান তিনি। বলেন, ‘জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বীরত্বের সহিত শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আমি বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে আহ্বান করছি, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শত্রুকে প্রতিহত করুন…।’
ড. ফিরোজ মাহমুদের গবেষণা এবং তার সংগ্রহ করা পত্রিকা ঘেঁটে জানা যায়, ওই সময় কলকাতা থেকে রেডিও মনিটরিং করছিল অ্যাসোয়িটেড প্রেস, রয়টার্স ও দি ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল। তারা বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে গণহত্যার খবরটি যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ২৬ মার্চের কাগজ ২৫ তারিখ রাত ১০টার মধ্যে ছাপা হয়ে যায়।
এ কারণে পরের দিন ভারতবর্ষের অনেক পত্রিকা ঘেঁটে গণহত্যা কিংবা ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়া যায়নি। একই কারণে এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র গণহত্যার খবর দিতে পারেনি।
তবে সময়ের পার্থক্যের কারণে গণহত্যার সংবাদ প্রকাশে এগিয়ে ছিল উত্তর আমেরিকার পত্রিকাগুলো। এসব পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে গণহত্যার খবর ছাপা হয়। বার্তা সংস্থাগুলো থেকে নেওয়া সংবাদের ভাষা প্রায়শই এক এবং অভিন্ন। উদাহরণ হতে পারে, ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ম্যাসাচুসেটস থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত সংবাদপত্র দি সান। পত্রিকাটিতে বাংলাদেশে গণহত্যার কথা জানানো হয়েছে শেখ মুজিবের উদ্ধৃতি দিয়ে। লেখা হয়েছে- ‘Sheikh Mujibur Rahman said the fighting started when ÔPakistan arms forces attacked East Pakistan rifle base at Pielkhana and the Rajabag (Rajarbagh) police station in Dacca.’
সংবাদে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা থেকে পাওয়া গণহত্যার তথ্য জানিয়ে লেখা হয়, ঐব (শেখ মুজিব) said, they killed a number of unarmed people. ÔPeople are fighting gallantly with the enemy for the cause of freedom of Bangla Desh. He called on every section of Bangla Desh to resist the enemy forces at aû cost. নর্থ ইস্টার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত ‘দি টাইমস স্ট্যান্ডার্ড’ একইভাবে শেখ মুজিবকে উদ্ধৃত করে গণহত্যার খবর দেয়।
সময়ের পার্থক্য পরিষ্কার করে ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, বঙ্গবন্ধু যদি ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১৫ মিনিটে ঘোষণা দিয়ে থাকেন, তাহলে নিউইয়র্কে তখন ২৫ মার্চ দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট। শিকাগোতে ২৫ মার্চ ১১টা ১৫ মিনিট। ক্যালিফোর্নিয়ায় ২৫ মার্চ ৯টা ১৫ মিনিট। ফলে ওই সব অঞ্চলের পত্রিকাগুলো সংবাদ তৈরি ও ছাপানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিল।
এ কারণে ২৬ মার্চ সকালে উত্তর আমেরিকার কয়েক হাজার পত্রিকায় গণহত্যার খবর প্রকাশিত হয়। আর ২৭ মার্চ জেনে যায় সারা দুনিয়া। সব পত্র-পত্রিকাই শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা করার খবর দেয়। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট হিসেবে গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয় বলে জানান গবেষক।
বঙ্গবন্ধু তিনটি গোপন ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে তিনটি ঘোষণা দিয়েছিলেন জানিয়ে ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ওই গোপন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণায় ছিল গণহত্যার তথ্য। শেখ মুজিবের দেওয়া বলেই ওই তথ্য বিশেষ আমলে নিয়েছিল বিশ্বমিডিয়া।
এদিকে, বঙ্গবন্ধুর পার্সনাল এইড হাজি গোলাম মোরশেদের সাক্ষাৎকারেও গোপন ট্রান্সমিটার ও সেটি ব্যবহার করে দেওয়া ঘোষণার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’শিরোনামে লেখা বইতে যুক্ত করা সাক্ষাৎকারে গোলাম মোরশেদ বলেছেন, ‘আমি সোজা ওপরে উঠে গেলাম। ওপরে উঠে দেখি বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে বসে আছেন। আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। ‘They are coming to arrest me. I have decided to stay.’ তখন রাত সাড়ে দশটার মতো বাজে বলে জানান গোলাম মোরশেদ।
এর পরের ঘটনাবলি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাত ১১টা বেজে গেল, বারোটা প্রায় বাজে বাজে, এমন সময় একটা টেলিফোন আসল। বলে, ‘আমি বলদা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব?’ আমি মুজিব ভাইয়ের কাছে দৌড়ে গেলাম, বললাম যে ফোন এসেছে- ‘মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে। মেশিন নিয়ে আমি কী করব?’ উনি বললেন, ‘মেশিনটা ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বলো।’
এই মেশিনটিই গোপন ট্রান্সমিটার বলে চিহ্নিত করেন ড. ফিরোজ মাহমুদ। তার মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি এই সব মেশিন ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বিশ্ববাসীকে গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। তার বার্তাগুলোকে সূত্র ধরেই গণহত্যার খবর প্রকাশ করেছিল বিশ্বগণমাধ্যম।