প্রফেসর ডা. মো. মতিয়ার রহমান.
এফ আর সি এস ( গ্লাসগো)
[ পূর্ব প্রকাশের পর ]
আমাদের গবেষণা মতে, কুরআন ও হাদীসের সরাসরি তথ্যের ভিত্তিতে, কুরআনকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে ব্যবহারের মূলনীতি (উসূল/Principle) ৯টি। যথা:
১. কুরআনে পরস্পর বিরোধী কোনো বক্তব্য নেই। ২. কুরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা কুরআন। ৩. একই বিষয়ের সকল আয়াত পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। ৪. কুরআন বিরোধী কথা যে গ্রন্থেই থাকুক তা মিথ্যা। ৫. অতীন্দ্রিয় বিষয় ছাড়া সকল সত্য উদাহরণকে আল্লাহর কাছ থেকে আসা সত্য শিক্ষার মর্যাদা দেওয়া। ৬. একাধিক অর্থবোধক শব্দ বা আয়াতের অর্থ বা ব্যাখ্যা করার সময় আকলের রায় বা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তথ্যের সাথে মেলানোর চেষ্টা করা। ৭. আল কুরআনের সকল আয়াতের শিক্ষা বর্তমানে চালু আছে অর্থাৎ কুরআনের কোনো আয়াতের শিক্ষা রহিত (মানসূখ) হয়নি বিষয়টি মনে রাখা। ৮. যে বিষয় কুরআনে নেই সেটি ইসলামের মৌলিক বিষয় নয়। ৯. আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের জ্ঞান।
আর কুরআনের সঠিক জ্ঞানার্জন বা ব্যাখ্যা করার জন্য আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের জ্ঞান এবং অন্য ৮টি মূলনীতির মধ্যকার সম্পর্কের বিভিন্ন অবস্থান হলো-
অবস্থান-১ আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের ভালো জ্ঞান না থাকলেকুরআন সরাসরি অধ্যয়ন করে জ্ঞানার্জন করা সম্ভব নয়। অবস্থান-২ আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের পণ্ডিত ব্যক্তিও কুরআনের যথাযথ জ্ঞানার্জন বা অর্থ ও ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হবেন যদি তিনি ওপরে বর্ণিত ৮টি মূলনীতি খেয়ালে না রাখেন বা ব্যবহার করতে না পারেন।
অবস্থান-৩ আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের জ্ঞান না থাকা ব্যক্তিও অনুবাদ পড়ে সেখানকার ভুল থেকে (যদি থাকে) নিজেকে বাঁচিয়ে কুরআনের ভালো জ্ঞানার্জন করতে পারবেন, যদি তিনি ওপরে বর্ণিত ৮টি মূলনীতি খেয়াল রাখেন বা ব্যবহার করতে পারেন। অবস্থান-৪ আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের কিছু জ্ঞান থাকা ব্যক্তি অনুবাদ গ্রš’ সম্পাদনা করে কুরআনের ভালো অনুবাদ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করতে পারবেন, যদি তিনি ওপরে বর্ণিত ৮টি মূলনীতি খেয়াল রাখেন বা ব্যবহার করতে পারেন। অবস্থান-৫ কুরআন সবচেয়ে ভালো বুঝতে, বোঝাতে, অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতে পারবেন সেই ব্যক্তি যার ওপরে বর্ণিত ৮টি মূলনীতি খেয়ালে আছে বা ব্যবহার করার যোগ্যতা আছে এবং আরবী ভাষা ও ব্যাকরণেরও ভালো জ্ঞান আছে। এ মূলনীতিসমূহ খেয়ালে রেখে চলুন এখন জানা ও পর্যালোচনা করা যাক মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় সম্পর্কে কী তথ্য আল কুরআনে আছে-
তথ্য-১
আর তোমার রব যখন ফেরেশতাদের বললেন- নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে এক খলিফা (প্রতিনিধি) পাঠাতে যাচ্ছি । তারা বলল- আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে পাঠাতে যাচ্ছেন , যারা সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরাই আপনার প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করছি এবং আপনার মহিমা ঘোষণা করছি (উপাসনা করছি)। তিনি বললেন- নিশ্চয় আমি তা জানি যা তোমরা জানোনা। (সুরা বাকারা/২: ৩০) ব্যাখ্যা:আয়াতটি থেকে জানা যায়- মহান আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টি করে তাকে প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরেশতাদের ডেকে তাঁর সিদ্ধান্ত জানান। ফেরেশতারা তখন জানতে চান- তিনি কি দুনিয়ায় এমন জীব পাঠাতে যাচ্ছেন যারা সেখানে বিশৃঙ্খলা, রক্তারক্তি, হানাহানি ইত্যাদি অন্যায় কাজ করবে? আর যদি উপাসনামূলক কাজ করার উদ্দেশ্যে তাদের সৃষ্টি করে থাকেন, তবে ঐ উপাসনামূলক কাজগুলো করার জন্যে তারাই কি যথেষ্ট নয়? তখন আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয় আমি যা জানি তোমরা তা জানো না’। এ কথার মাধ্যমে আল্লাহ ফেরেশতাদের জানিয়ে দিয়েছেন- মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তোমরা যে দুটো কথা বললে, তার কোনোটাই আমার মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নয়। তাই, এ আয়াতের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আল্লাহ দুটো বিষয়কে নাকচ করে দিয়েছেন। বিষয় দুটো হলো- ১.বিশৃঙ্খলা, রক্তারক্তি, হানাহানি ইত্যাদি তথা ন্যায়-অন্যায় বিভাগের অন্যায় কাজগুলো। ২.উপাসনামূলক কাজ (তাসবিহ-তাহলিল, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ ইত্যাদি)। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী সেটি আয়াত থেকে সরাসরি জানা না গেলেও আয়াতটির আলোকে বলা যায়মানব জীবনের ৪ বিভাগের কাজের মধ্যে- ১.উপাসনামূলক বিভাগের বিষয়গুলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নয়। ২.‘ন্যায় ও অন্যায়’ বিভাগের ‘অন্যায়’ কাজগুলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নয়। তাহলে ধরে নেওয়া যায়- এ বিভাগের ‘ন্যায়’ কাজগুলো তথা ‘ন্যায়ের বাস্তবায়ন’ মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হতে পারে।
তথ্য-২ আর শপথ মানুষের মনের (অন্তর/গরহফ) এবং সেই সত্তার যিনি তাকে (মনকে) সঠিক গঠনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে (মনকে) ‘ইলহাম’ করেছেন তার অন্যায় ও ন্যায় (বোঝার শক্তি)। অবশ্যই সে সফল হলো যে তাকে (ঐ শক্তিকে) উৎকর্ষিত করলো। আর অবশ্যই সে ব্যর্থ হলো যে তাকে (ঐ শক্তিকে) অবদমিত করলো। (সুরা আশ্-শামস/৯১ : ৭-১০)
ব্যাখ্যা: ৭নং আয়াতটিতে আল্লাহ তা‘য়ালা বলেছেন, তিনি মানুষের মনকে সঠিক গঠনে সৃষ্টি করেছেন। এ কথার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- মানুষকে যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তা করার জন্য যে গঠন বা গুণ দরকার, সৃষ্টিগতভাবে (জন্মগতভাবে) সে গঠন দিয়ে মানুষের মনকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর সে গঠন বা গুণ কী তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে পরের (৮নং) আয়াতে।
৮ নং আয়াতটিতে আল্লাহ তা‘য়ালা বলেছেন- তিনি মানুষের মনে ‘ইলহাম’ করেছেন তার অন্যায় ও ন্যায় বিষয়। ‘ইলহাম’ হলো অতিপ্রাকৃতিক এক পদ্ধতি। মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে দুটি শক্তি দেওয়া হয়েছে ‘জীবনী শক্তি’ এবং ‘জ্ঞানের শক্তি’। ‘জীবনী শক্তি’ দেওয়ার আল্লাহর পদ্ধতি হলো ‘ফুঁক’। এটি জানানো হয়েছে সুরা হিজরের ২৯ নং আয়াতে। আর ‘জ্ঞানের শক্তি’ দেওয়ার আল্লাহর পদ্ধতি হলো ‘ইলহাম’। এটি আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে জানানো হয়েছে।
তাই, এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন- সৃষ্টি/জন্মগতভাবে, ‘ইলহাম’ নামক এক অতিপ্রাকৃতিক পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি মানুষের মনকে, কোনটি অন্যায় কাজ ও কোনটি ন্যায় কাজ তা বোঝার শক্তি দিয়েছেন। আর তাই-
আল কুরআনে ন্যায় কথা বা কাজকে মা‘রুফ নাম দেওয়া হয়েছে। মা’রুফ শব্দটি এসেছে আরাফা শব্দ থেকে। যার অর্থ হলো ‘জানা’। অর্থাৎ মারুফ কথা বা কাজ হচ্ছে সেই কথা বা কাজ যা মানুষ জন্মগতভাবে তথা বিনা শিক্ষায় জানতে বা বুঝতে পারে। জ্ঞানের এ শক্তিটি পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত (বালিগ না হওয়া পর্যন্ত) ইসলামে নিষিদ্ধ কাজ করলে অপরাধ ধরা হয় না। উল্লেখ্য চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- কিডনি, লিভার, ফুসফুস, ব্রেইন ইত্যাদি পরিপক্ক হওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। সে সময় প্রত্যেক অঙ্গের জন্য ভিন্ন।
বাস্তবেও দেখা যায়- মানুষের জীবনের বিভিন্ন কাজের মধ্যে শুধু ন্যায় ও অন্যায় বিভাগের কাজগুলো মানুষ বিনা শিক্ষায় তথা জন্মগতভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু অন্য ৩ বিভাগের বিষয়গুলো জানার জন্য কুরআন-হাদীস বা অন্যান্য গ্রন্থ অবশ্যই পড়তে হয় বা কারো কাছ থেকে তা জেনে নিতে হয়। যেমন-
১.সালাত, যাকাত, সিয়াম ও হাজ্জ ইত্যাদি যে মানুষের করণীয় কাজ তা কুরআন-হাদীস না পড়লে বা কারো কাছ থেকে না শুনলে কেউই বুঝতে পারবে না। ২. কোন রোগের কী লক্ষণ বা ঔষধ তা চিকিৎসা বিদ্যা না পড়লে বা কারো কাছ থেকে না শুনলে কেউ বুঝতে পারবে না। জন্মগতভাবে মানব মনের পাওয়া এ শক্তিটিই হলো- বোধশক্তি/Common Sense/বিবেক বা আল্লাহ প্রদত্ত সাধারণ জ্ঞান।
৯ ও ১০নং আয়াত দুটি থেকে জানা যায়Ñ এ শক্তিটি উৎকর্ষিত ও অবদমিত হতে পারে। এখান থেকে বোঝা যায়- এ শক্তিটিকে জন্মগতভাবে একটি বুনিয়াদি জ্ঞান (Memory) ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা (Processing Power) দেওয়া আছে। আর ঐ বুনিয়াদি জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও হ্রাস উভয়টি সম্ভব।
বর্তমান যুগের মানুষের তৈরিকৃত যান্ত্রিক জ্ঞানের শক্তি- কম্পিউটারের উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি বোঝা খুবই সহজ। কম্পিউটার তৈরি করার সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্ঞান (Memory) ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা (Processing Power) দিয়ে তৈরি করা হয়। এরপর এটির জ্ঞান (Memory) বাড়াতে পারলে বিশ্লেষণ ক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে যায়।
তাই, সহজে বোঝা যায় ৯ ও ১০ নং আয়াত দুটির তথ্য হলো- মানব মনে জন্মগতভাবে একটি বুনিয়াদি জ্ঞান (Memory) ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা (Processing Power) দেওয়া আছে। ঐ বুনিয়াদি জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ে বা কমে তথা বাড়ানো বা কমানো যায়। কীভাবে এ বিষয়টি ঘটে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে‘ইসলামী জীবন বিধানে Common Sense এর গুরুত্ব কতটুকু এবং কেন?’(গবেষণা সিরিজ-৬) নামক বইটিতে।
ইতোমধ্যে (Common sense-এর ৩ নং দৃষ্টিকোণ) আমরা জেনেছিÑকুরআন থেকে যদি জানা যায়, জীবনের বিভিন্ন কাজের মধ্যে শুধু কিছু কাজকে আল্লাহ জন্মগতভাবে মানুষকে বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন, তবে বুঝতে হবে সে কাজগুলোই হবে আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। তাই এ আয়াতের আলোকে বলা যায়Ñ ন্যায় ও অন্যায় বিভাগের কাজগুলোই হলো আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যমূলক কাজ।
আবার Common sense -এর ১ নং দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা জেনেছি- কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের একটি বা একটি বিভাগ হয় ঐ বিষয়ের উদ্দেশ্য এবং বাকি সব হয় পাথেয়। তাই এ আয়াতের আলোকে পরোক্ষভাবে বলা যায়- মানব জীবনের অন্য সকল বিভাগের কাজগুলো হলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধনের পাথেয় তথা সহায়ক কাজ।
তথ্য-৩
তোমরা সর্বোত্তম উম্মত, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে, তোমরা জানা বিষয় বাস্তবায়ন এবং অস্বীকার করা বিষয় প্রতিরোধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। … … …
(সুরা আল-ইমরান/৩ : ১১০)
ব্যাখ্যা : আল কুরআনে উম্মাত শব্দটি যে সকল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তার একটি হলো বিভিন্ন জাতিগত সৃষ্টি। যেমন-
আর পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন কোনো জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে উড়ে এমন কোনো পাখি নেই, যারা তোমাদের মতো একটি উম্মত (সৃষ্টিগত জাতি) নয়। … … … (সুরা আন’আম/৬ : ৩৮) আয়াতটির অংশভিত্তিক শিক্ষা ‘তোমরা সর্বোত্তম উম্মত’ অংশের শিক্ষা : মানুষ হলো আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতিগত সৃষ্টি (আশরাফুল মাখলুকাত)। ‘তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে’ অংশের শিক্ষা : মানুষকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ করা (মানুষ মানুষের জন্য)।
‘তোমরা জানা বিষয় বাস্তবায়ন এবং অস্বীকার করা বিষয় প্রতিরোধ করবে’ অংশের শিক্ষা : এ কথার অর্থ হলো- তোমাদের মন জন্মগতভাবে যে বিষয়গুলো জানে তা পালন বা বাস্তবায়নকরবে এবং যা অস্বীকার করে তা থেকে দূরে থাকবে বা তা প্রতিরোধ করবে। তাই, জানা বিষয় বাস্তবায়ন এবং অস্বীকার করা বিষয় প্রতিরোধ করা কথাটির প্রকৃত অর্থ হলো- তোমাদের জন্মগতভাবে জানা ন্যায় বিষয়গুলো বাস্তবায়ন এবং অন্যায় বিষয়গুলো প্রতিরোধ করবে।
‘আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে’ অংশের শিক্ষা : ঈমান হলো- জ্ঞান+বিশ্বাস। তাই, আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা কথাটির অর্থ হবে- আল্লাহ সম্পর্কে জানা ও তা বিশ্বাস করা। আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের সকল মৌলিক তথ্যধারণকারী আধার হলো আল কুরআন। আবার কুরআন হলো সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। অর্থাৎ মানদ-। তাই আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা কথাটির সর্বাধিক তথ্যবহুল অর্থ হবে কুরআনকে সকল জ্ঞানের আধার ও মানদণ্ড হিসেবে বিশ্বাস করা। প্রশ্ন হলো- জন্মগতভাবে জানা ন্যায় কাজ বাস্তবায়ন এবং অন্যায় কাজ প্রতিরোধ করার সাথে কুরআনকে সকল জ্ঞানের আধার ও মানদণ্ড হিসেবে বিশ্বাস করার কথাটিকে কেন যুক্ত করা হয়েছে।
এ প্রশ্নের উত্তর-
১. ন্যায় ও অন্যায় কাজ কোনগুলো তা আল্লাহ প্রথমে রুহের জগতে সাক্ষ্য ও ক্লাস নিয়ে প্রত্যেক রুহকে জানিয়ে দিয়েছেন এভাবে- অতঃপর তিনি আদমকে সকল (গুণবাচক) ইসম শেখালেন, তারপর সেগুলো ফেরেশতাদের কাছে উপস্থাপন করলেন, অতঃপর বললেন- তোমরা আমাকে এ ইসমগুলো সম্পর্কে বলো যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো।(সুরা আল বাকারা/২ : ৩১) ব্যাখ্যা : গুণবাচক ইসম হলো মানব জীবনের ন্যায়-অন্যায়, সাধারণ নৈতিকতা, বান্দার হক বা মানবাধিকারের বিষয়সমূহ। তাই, আল্লাহ তা‘য়ালা শাহী দরবারে ক্লাস নিয়ে, সকল মানব রুহকে মানব জীবনের ন্যায়-অন্যায়, সাধারণ নৈতিকতা, বান্দার হক বা মানবাধিকারের সকল বিষয় মানুষকে শিখিয়েছেন। (সুরা বাকারা/২ : অতঃপর ঐ বিষয়গুলো মহান আল্লাহ মানব ভ্রূণের ব্রেইনে Common Sense জ্ঞানের উৎস (Micro Chips) হিসেবে জন্মগতভাবে দিয়ে দিয়েছেন। তথ্যটি কুরআনে উল্লেখিত আছে সুরা আশ্ শাসের ৭-১০ নং আয়াতের মাধ্যমে (ওপরে আলোচনা করা হয়েছে)।
২. ন্যায় ও অন্যায় কাজগুলোর মৌলিক বাস্তবায়ন পদ্ধতিও আল কুরআনে নির্ভুলভাবে উল্লিখিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে।
৩. ন্যায় ও অন্যায় কাজগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যোগ্য মানুষ তৈরির প্রোগ্রামও কুরআনে নির্ভুলভাবে উল্লিখিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে।
ঐ ধরনের যোগ্য মানুষ ছাড়া কেউ ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে গেলে তা সমগ্র মানব জাতির জন্য কল্যাণকর হবে না। তা হবেব্যক্তি, পরিবার, দল বা নিজ (ভৌগলিক জাতির) স্বার্থ উদ্ধারের জন্য।
তাই, আয়াতটি থেকে প্রত্যক্ষভাবে যা জানা যায়-
১. মানুষ হলো মহান আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতিগত সৃষ্টি (আশরাফুল মাখলুকাত)। ২. মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো- মানুষের কল্যাণ করা (মানুষ মানুষের জন্য)। ৩. সে কল্যাণের উপায় হলো- মানুষের জন্মগতভাবে জানা ন্যায় কাজগুলো বাস্তবায়ন এবং অন্যায় কাজগুলো প্রতিরোধ করা। ৪. ঐ কাজসহ সকল কাজ করার সময় কুরআনকে সকল জ্ঞানের আল্লাহ প্রদত্ত হার্ড কপি হিসেবে সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে।
আর আয়াতটি থেকে পরোক্ষভাবে জানা যায়- মানব জীবনের অন্য বিভাগের কাজগুলো হলো মানুষ সৃষ্টির পাথেয় (মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ)।
তথ্য-৪.১
আর নিশ্চয় আমরা এই কুরআনে মানুষের জন্য সব ধরনের (Common Sense, বিজ্ঞান, সত্য ঘটনা, সত্য কাহিনি ইত্যাদি) উদাহরণ উপস্থাপন করেছি যাতে তারা শিক্ষা-গ্রহণ করতে পারে। আরবী ভাষার এই কুরআনে কোনো বক্রতা নেই, যেন তারা (কুরআন থেকে শিক্ষা নিয়ে) আল্লাহ-সচেতন হতে পারে। (সুরা যুমার/৩৯ : ২৭, ২৮)
ব্যাখ্যা: এ আয়াতসহ অনেক আয়াত থেকে জানা যায়- আল্লাহ তা‘য়ালাকুরআনের মাধ্যমে জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় মানুষকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। Common Sense অনুযায়ী যে বিষয় থেকে কোনো কিছু শিক্ষা দিতে চাওয়া হয় তা সবসময় পাথেয় বিভাগের বিষয় হয়। তাই, এ সকল আয়াত থেকে জানা যায়- কুরআনের জ্ঞানার্জন করা মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়।
তথ্য-৪.২
আর যারা ধন-সম্পদ লোক দেখানোর জন্যে ব্যয় করে, এরা না আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না পরকালের প্রতি। … … …
(সুরা নিসা/৪ : ৩৮)
ব্যাখ্যা: ধন-সম্পদ লোক দেখানোর জন্যে ব্যয় করা মানব জীবনের ন্যায়-অন্যায় বিভাগের একটি অন্যায় কাজ। তাই এ আয়াতসহ অনেক আয়াত থেকে জানা যায়- খুশি মনে ন্যায়-অন্যায় বিভাগের একটি অন্যায় কাজ করলে ঈমান থাকে না। এর কারণ হলো- ঈমান আনতে বলার উদ্দেশ্য হলো মানুষের মন-মানসিকতাকে এমনভাবে গঠন করা যেন তা মানুষকে অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত রাখে। Common Sense অনুযায়ী যে বিষয় দিয়ে কোনো কিছু গঠন করতে চাওয়া হয় তা সবসময় পাথেয় বিভাগের বিষয় হয়। তাই, এ সকল আয়াত থেকে জানা যায়- ঈমান আনা মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়।
তথ্য-৪.৩
আর তুমি সালাত কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে ও রাতের প্রথমাংশে। নেক আমল (সালাত) অবশ্যই (ছগীরা) গুনাহকে মিটিয়ে দেয়। এটি (সালাত) (কুরআনের শিক্ষা) স্মরণ রাখার এক অতি বড়ো ব্যবস্থা, (কুরআনের শিক্ষা) স্মরণ রাখতে চাওয়া ব্যক্তিদর জন্য।
(সুরা হুদ/১১ : ১১৪)
ব্যাখ্যা : আয়াতটির ‘এটি (সালাত) (কুরআনের শিক্ষা) স্মরণ রাখার এক অতি বড়ো ব্যবস্থা, (কুরআনের শিক্ষা) স্মরণ রাখতে চাওয়া ব্যক্তিদের জন্য’ অংশের ব্যাখ্যা হলো- সালাত তাত্ত্বিক (Theoretical) ও ব্যাবহারিক (Practical) উপায়ে, রিভিশন (Revision) দেওয়ার মাধ্যমে, কুরআনের শিক্ষা স্মরণ রাখার অতি বড়োএক ব্যবস্থা, কুরআনের শিক্ষা স্মরণ রাখতে চাওয়া ব্যক্তিদের জন্য।
তাহলে, সালাতের অনুষ্ঠান ও পঠিত বিষয় থেকে আল্লাহ তা‘য়ালা বিভিন্ন বিষয় মানুষকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। Common Sense যে বিষয় থেকে কোনো কিছু শিক্ষা দিতে চাওয়া হয়, তা সবসময় পাথেয় বিভাগের বিষয় হয়। তাই, এ আয়াত থেকে জানা যায়- সালাত মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়।
তথ্য-৪.৪
হে যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের ওপর সিয়াম বিধিবদ্ধ (ফরজ) করা হয়েছে যেমন তা বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে (তা থেকে শিক্ষা নিয়ে) তোমরা (বিশেষ ধরনের) আল্লাহ-সচেতন হতে পারো।
(সুরা বাকারা/২ : ১৮৩)
ব্যাখ্যা:আয়াতটির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘য়ালা সিয়াম ফরজ করার কারণটি বলে দিয়েছেন। সে কারণ হলো- সিয়ামের অনুষ্ঠানের শিক্ষার মাধ্যমে এক বিশেষ ধরনের আল্লাহ সচেতন (মুত্তাকী) মানুষ গঠন করা। সে বিশেষ ধরনের আল্লাহ সচেতন মানুষ হলো তারা যারা- পেটের ক্ষুধা ও জৈবিক চাহিদা উপেক্ষা করে আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকবে। তাই, এ আয়াতের আলোকেও সহজে বলা যায়- সিয়াম মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়।
তথ্য-৪.৫
এদের (কুরবানীর পশুর) গোশত এবং রক্ত কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং পৌঁছে (এর মাধ্যমে অর্জিত) তোমাদের (বিশেষ ধরনের) আল্লাহ-সচেতনতা; … … …
(সুরা হজ্জ/২২ : ৩৭)
ব্যাখ্যা: এ আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন- কুরবানীকৃত পশুর গোশত ও রক্ত তাঁর কাছে পৌঁছায় না। তাঁর কাছে পৌঁছায় কুরবানীর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি যে বিশেষ ধরনের আল্লাহ সচেতনতার শিক্ষা দিয়েছেন সেটি। সে শিক্ষাটি হলো- প্রচণ্ড – ত্যাগ স্বীকার এমনকি জীবন গেলেও আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা না করা। তাই, এ আয়াতের আলোকে সহজে বলা যায়- কুরবানী মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়।
সম্মিলিত শিক্ষা: এগুলোসহ আরও আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়- কুরআন তিলাওয়াত, ঈমান আনা, সালাত, সিয়াম, কুরবানী তথা উপাসনা বিভাগের বিষয়গুলো মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়।
♣♣ এ পর্যন্ত উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে-
১. জন্মগতভাবে জানা তথা মানব জীবনের ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলো হলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
২. মানব জীবনের অন্য ৩ বিভাগের (উপাসনা, শরীর-স্বাস্থ্য গঠন ও পরিবেশ-পরিস্থিতি গঠন) কাজগুলো মানুষ সৃষ্টির পাথেয় তথা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সহায়ক বিষয়।
তথ্য-৫
আর আমি জ্বীন ও মানুষকে শুধু আমার দাসত্ব করার জন্য সৃষ্টি করেছি। (সুরা যারিয়াত/৫১ : ৫৬)
ব্যাখ্যা:কুরআনের যে সকল আয়াতের অসতর্ক ব্যাখ্যা, জীবনের সকল দিকের এক সময়ের শ্রেষ্ঠ মুসলিম জাতিকে বর্তমানে একটা চরম অধঃপতিত জাতিতে পরিণত করেছে তার মধ্যে এটি অন্যতম প্রধান। আয়াতটির দুটো অসতর্ক ব্যাখ্যা মুসলমান জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে চালু আছে এবং সে অনুযায়ী আমলও করা হচ্ছে ।
একটি অসতর্ক ব্যাখ্যা
বেশিরভাগ মুসলিম মনে করেন বা মেনে নিয়েছেন- ‘ইবাদত’ শব্দটি দিয়ে বোঝায় সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ, কুরবানী, তাসবিহ-তাহলীল ইত্যাদি উপাসনামূলক কাজ। তারা আরও মনে করেন ‘ইবাদত করার’ অর্থ হচ্ছে শুধু ঐ কাজগুলোর অনুষ্ঠানটি করা। তাই, বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম এ আয়াতের ভিত্তিতে সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ, কুরবানী ইত্যাদি উপাসনামূলক কাজগুলোর অনুষ্ঠানটি পালন করাকে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ধরে নিয়েছে।আর তাই দেখা যায়, কুরআন ও সুন্নাহ ‘ন্যায় এবং অন্যায় বিভাগে যে কাজগুলোকে উল্লেখ করেছে সেগুলো পালন করা এবং উপাসনামূলক কাজগুলো থেকে আল্লাহ যে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন সে শিক্ষাগুলো জানা ও তার ওপর আমল করার দিকে তাদের খেয়াল খুবই কম।
আলোচ্য আয়াতটির এ অর্থ ও ব্যাখ্যা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, আয়াতটির এটি পূর্বে আলোচনাকৃত আল কুরআনের সকল আয়াতের বক্তব্যের স্পষ্ট বিরোধী।
দ্বিতীয় অসতর্ক ব্যাখ্যা
আয়াতটির দ্বিতীয় যে ব্যাখ্যা বর্তমান মুসলিম সমাজে চালু আছে তা হলো – ‘আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমার দাসত্ব করার জন্য’। আয়াতটির এ অর্থে সঠিক অর্থটিই করা হয়েছে। কারণ, ঐ শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ থেকে। এ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘দাস’। কিš‘ আয়াতটির অনুবাদে দাসত্ব শব্দটির কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে সরাসরি এভাবে লিখলে বা বললে যে অসুবিধা হয় তা হলো- উপাসনা বিভাগের কাজগুলোও মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের মধ্যে এসে যায়। কারণ, উপাসনা বিভাগের কাজগুলোও (ঈমান, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ, কুরবানী ইত্যাদি) আল্লাহর দাসত্বের অন্তর্ভুক্ত তথা আল্লাহর একজন দাসের করণীয় কাজ।
তাই আয়াতটির অনুবাদ এটি করলে তা পূর্বে আলোচনাকৃত আল কুরআনের সবগুলো তথ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। সুতরাং আয়াতটির অনুবাদ এভাবে করা বা লেখাও সঠিক নয়।
আয়াতটির সঠিক অনুবাদ বা ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আল কুরআনের অন্য সকল আয়াতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং শব্দের সঠিক অর্থ ধরে আয়াতটির সঠিক অনুবাদ বা ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ হবে- ‘আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার দাসত্বের শর্ত পূরণ করে জীবন পরিচালনা করার জন্য’।
এ অনুবাদটি মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনাকারী অন্যান্য আয়াতের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হবে। কারণ, জীবন পরিচালনা নামক ব্যাপক কর্মকাণ্ডটি আল্লাহর দাসত্ব হিসেবে গণ্য হতে হলে নিম্নের শর্তগুলো পূরণ করতে হয়-
১. জীবন পরিচালনার সময় (জীবনের প্রতিটি কাজ করার সময়) আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সবসময় সামনে রাখতে হবে।
২. জীবন পরিচালনার সময় মানুষ সৃষ্টির ‘উদ্দেশ্য বিভাগ’ তথা ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলোকে উদ্দেশ্যের স্থানে রেখে জীবনকে পরিচালনা করতে হবে।
৩. জীবন পরিচালনার সময় মানুষ সৃষ্টির ‘পাথেয় বিভাগ’ তথা উপাসনা, শরীর-স্বাস্থ্য গঠন ও পরিবেশ-পরিস্থিতি গঠন বিভাগের কাজগুলোকে উদ্দেশ্য বিভাগের কাজগুলো পালনে সহায়তামূলক কাজের স্থানে রেখে জীবনকে পরিচালনা করতে হবে।
৪. জীবনের প্রতিটি কাজ আল্লাহর জানানো এবং রাসূল (সা.)-এর দেখানো পদ্ধতিতে করতে হবে।
৫. জীবনের আল্লাহ ঘোষিত আনুষ্ঠানিক উপাসনামূলক কাজগুলো (ঈমান আনা, সালাত, যাকাত, সিয়াম ও কুরবানী) নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে প্রতিটি অনুষ্ঠান ও পঠিত বিষয় থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষাগুলো নিতে হবে।
৬. আনুষ্ঠানিক উপাসনাগুলো থেকে নেওয়া শিক্ষা বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।
৭. জীবন পরিচালনার সময় আল্লাহর জানানো মৌলিক কাজগুলোর একটিও বাদ দেওয়া যাবে না।
৮. জীবন পরিচালনার সময় গুরুত্ব অনুযায়ী কাজগুলো আগে বা পরে পালন করা।
বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘মু‘মিনের আমল কবুলের শর্ত প্রচলিত ধারণা ও সঠিক তথ্য’(গবেষণা সিরিজ-৫) নামক বইটিতে।
সুধী পাঠক, চিন্তা করে দেখুন- মাত্র একটিশব্দের অসতর্ক ব্যাখ্যা ও বুঝ কীভাবে পৃথিবীর এক সময়ের শ্রেষ্ঠ জাতিকে চরম অধঃপতিত জাতিতে পরিণত করেছে বা কীভাবে তাদের জান্নাত থেকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । এই অসতর্ক ব্যাখ্যাটির জন্য অধিকাংশ মুসলিম আজ মনে করছে বা মেনে নিয়েছে, তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ, কুরবানী, তাসবিহ-তাহলীল ইত্যাদি উপাসনামূলক কাজগুলো করার জন্য। তাই তো দেখা যায়-
১. উপাসনামূলক আমলগুলো নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন এমন মুসলিমদের অধিকাংশেরই ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলো বাস্তবায়নের প্রতি তেমন বা মোটেই খেয়াল নেই।
২. মুসলিম সমাজ বা দেশগুলোতে ন্যায় কাজের দারুণ অভাব, কিন্তু অন্যায় কাজে ভরপুর।
তথ্য-৬
(বাকারা/২ : ৩০) ও(আন-আম/৬ : ১৬৫)
তাফসীর গ্রš’সমূহে প্রথম আয়াতটির অনুবাদ করা হয়েছে ‘আমি পৃথিবীতে খলিফা পাঠাতে যাচ্ছি এবং দ্বিতীয়টির অনুবাদ করা হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের পৃথিবীতে খলিফা করে পাঠিয়েছেন’। আর এ অনুবাদের ব্যাখ্যা থেকে বলা হয়েছে- ‘খলিফার দায়িত্ব পালন করার জন্যে আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টি করেছেন’।
আয়াত দুটির তরজমা এভাবে করলে খলিফার করণীয় সকল কাজই তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যের মধ্যে এসে যায়। উপাসনামূলক (সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ, কুরবানী ইত্যাদি) কাজগুলোও খলিফার কাজ। তাই এভাবে অনুবাদ করলে ঐ কাজগুলোও মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের মধ্যে এসে যায়। এটা পূর্ব উল্লেখিত কুরআনের অনেক তথ্যের বিরোধী কথা। সুতরাং আয়াত দুটির এভাবে উপস্থাপনকৃত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আয়াত দুটির সঠিক অনুবাদ বা ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ : খলিফা অর্থ প্রতিনিধি। প্রতিনিধির কাজ হলো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বলে দেওয়া অবশ্য পূরণীয় সকল শর্ত পূরণ করে তার প্রতিনিধিত্ব করা। প্রতিনিধিত্বের অবশ্য পূরণীয় শর্তগুলো আর দাসত্বের অবশ্য পূরণীয় শর্তগুলো একই। অর্থাৎ ৫ নং তথ্যে দাসত্বের যে শর্তগুলো উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিনিধিত্বের শর্তগুলো হবে হুবহু ঐ রকম। শুধু সেখানে ‘দাস ও দাসত্বের’ স্থানে‘প্রতিনিধি ও প্রতিনিধিত্ব’ পড়লেই হবে।
তাই, প্রথম আয়াতটির সঠিক অনুবাদ হবে- ‘আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধিত্বের শর্ত পূরণ করে জীবন পরিচালনাকারী সৃষ্টি পাঠাতে যাচ্ছি এবং দ্বিতীয় আয়াতটির সঠিক অনুবাদ হবে- ‘তিনিই তাঁর প্রতিনিধিত্বের শর্ত পূরণ করে জীবন পরিচালনাকারী সৃষ্টিরূপে তোমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন’।
আর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অন্য আয়াতগুলোর বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই আয়াত দুটির চূড়ান্ত ব্যাখ্যা হবে- ‘আল্লাহ্তা‘য়ালা জন্মগতভাবে জানা ন্যায় কাজ বাস্তবায়ন ও অন্যায় কাজ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে খলিফা হিসেবে জীবন পরিচালনা করার জন্য মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন’।
তথ্য-৭.১
… … … তাহলে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশের ওপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশকে অস্বীকার করছো? অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা এ ধরনের কাজ করে তাদের প্রতিদান দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছুই হবে না। আর কিয়ামতের দিন তাদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন। ওরাই তারা যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন কিনে নিয়েছে। তাই তাদের শাস্তি কমানো হবে না এবং তাদের কোনো সাহায্যও করা হবেনা।
(সুরা বাকারা/২ : ৮৫, ৮৬)
ব্যাখ্যা: ঈমান = জ্ঞান+ বিশ্বাস । তাই এখানে যারা আল্লাহর কিতাব কুরআনের কিছু অংশের জ্ঞানার্জন করবে (জানবে) ও বিশ্বাস করবে এবং কিছু অংশের জ্ঞানার্জন করবে না (জানবে না) ও বিশ্বাস করবে না তাদের সম্পর্কে আয়াতের- ১) প্রথমে বলা হয়েছে, দুনিয়ার জীবনে তাদের লাঞ্ছনা এবং পরকালে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। ২) শেষে বলা হয়েছে, তাদের শাস্তি কমানো হবে না এবং তাদের কোনো সাহায্যও করা হবেনা।
তাই আয়াতটির এ অংশের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- যারা কুরআনের বক্তব্যের কিছু জানবে ও বিশ্বাস করবে আর কিছু জানবে না ও বিশ্বাস করবে না, দুনিয়ায় তাদের দূর্ভোগ ও লাঞ্ছনা হবে এবং আখিরাতে হবে কঠিন স্থায়ী । কারণ, জ্ঞান ও বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষের আমল হয়। তাই, যারা কুরআনের বক্তব্যের কিছু জানবে ও বিশ্বাস করবে আর কিছু জানবে না ও বিশ্বাস করবে না, তারা কুরআনের কিছু বিষয় অনুসরণ করবে এবং কিছু বিষয় অনুসরণ করবে না।
কুরআনে আছে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ও পাথেয় বিভাগের সকল মূল বিষয়। তাই,এ আয়াত থেকে জানা যায়- ১) মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় বিভাগের যে বিষয়গুলো কুরআনে উল্লেখ আছে তার সবগুলো জানতে ও বিশ্বাস করতে হবে। ২) অনুসরণের মাধ্যমে সে জানা ও বিশ্বাসের প্রমাণ দেখাতে হবে।
তথ্য-৭.২
নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে সৎপথ স্পষ্ট হবার পর তা থেকে তাদের পেছনের দিকে ফিরে যায়, শয়তান তাদের প্ররোচিত করেছে এবং তাদের কাছে মিথ্যা আশাবাদকে প্রলম্বিত করেছে। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে তারা বলে- আমরা কিছু বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করবো। আর আল্লাহ তাদের গোপন ষড়যন্ত্র অবগত আছেন। অতঃপর তখন কেমন হবে যখন ফেরেশতা তাদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করতে করতে মৃত্যু ঘটাবে? এটা এজন্য যে, তারা তার অনুসরণ করে যা আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় এবং তাঁর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে।
এজন্যে তিনি তাদের সকল ‘আমল নিষ্ফল করে দেবেন। (সুরা মুহাম্মাদ/৪৭ : ২৫-২৮)
ব্যাখ্যা: প্রথম আয়াতটিতে কিতাবের মাধ্যমে হিদায়াত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পাওয়ার পর যারা তা থেকে ফিরে যায়, তাদের কিছু অবস্থা বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয় আয়াতটিতে এই ফিরে যাওয়া বলতে কী বোঝায়, তা বলা হয়েছে। ফিরে যাওয়া হলো- জীবনের কিছু ব্যাপারে আল্লাহর কিতাবকে অনুসরণ করা আর কিছু ব্যাপারে অন্য কারো (গায়রুল্লাহ্) কথা অনুসরণ করা।
এ ধরনের আচরণের ব্যাপারে এই আয়াতগুলোতে যা বলা হয়েছে তা হলো-
১. ঐ ধরনের আচরণের জন্যে শয়তান তাদের সামনে মিথ্যা আশা-আকাঙ্ক্ষার ধারা প্রশস্ত করে দিয়েছে। অর্থাৎ শয়তান তাদের ধারণা দিয়েছে, ঐ রকম আচরণ করলেও তারা সফল হবে এবং ইহকাল ও পরকালে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে।
২. ঐ ধরনের আচরণের জন্যে মৃত্যুকালে ফেরেশতারা তাদের মুখে ও পিঠে আঘাত করে জর্জরিত করবে।
৩. ঐ ধরনের আচরণের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে পছন্দ করা এবং সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করা।
৪. ঐ আচরণের জন্যে তাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে।
এ আয়াত থেকেও তাই জানা যায়- মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় বিভাগের যে বিষয়গুলো কুরআনে উল্লেখ আছে তার সবগুলো পালন করতে হবে।
তথ্য-৭.৩
আর যারা মানুষকে দেখানোর জন্য তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে তারা না আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং না আখিরাতে। আর তাদের সঙ্গী হয় শয়তান, আর সে সঙ্গী কতই না মন্দ! (সুরা নিসা/৪ : ৩৮)
ব্যাখ্যা: মানুষকে দেখানোর জন্য ধন-সম্পদ ব্যয়সহ যে কোনো কাজ করা (রিয়া) ইসলামের একটি মূল নিষিদ্ধ বিষয়। আর আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করে না বলে খেতাব পাওয়া ব্যক্তির জীবন শতভাগ ব্যর্থ। তাই, এ আয়াতের আলোকে বলা যায়Ñকুরআন উল্লেখ থাকা মূল নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের একটিও পালন করলে মানব জীবন শতভাগ ব্যর্থ হবে।
তথ্য-৭.৪
একজন মু’মিনকে হত্যা করা কোনো মু’মিনের জন্য সঙ্গত নয়, তবে ভুলবশত করলে স্বতন্ত্র কথা … … … আর যে ই”ছাকৃতভাবে কোনো মু’মিনকে হত্যা করে তার স্থানে জাহান্নামে, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে, আর আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হন, তাকে লা’নত করেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন মহাশাস্তি। (সুরা নিসা/৪ : ৯২, ৯৩)
ব্যাখ্যা: কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা বড়ো (মূল) নিষিদ্ধ কাজ। চিরকাল জাহান্নামে থাকার অর্থ জীবন শতভাগ ব্যর্থ। তাহলে এ আয়াতের আলোকে সাধারণভাবে বলা যায়- কুরআনে উল্লিখিত মূল নিষিদ্ধ বিষয়ের একটিও পালন করলে বা মূল করণীয় বিষয়ের একটিও পালন না করলে মানব জীবন শতভাগ ব্যর্থ হবে।
তথ্য-৭.৫
… … … অথচ আল্লাহ বেচা-কেনাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম; অতঃপর যে ব্যক্তির কাছে তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ পৌঁছার পর সে বিরত হয়েছে, সে পূর্বে যা খেয়েছে তা তারই (বিষয়), তবে তার বিষয়টি আল্লাহর কাছে সমর্পিত। আর যারা (নির্দেশ পাওয়ার পরও) পুনরাবৃত্তি করেছে তারা জাহান্নামের অধিবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সুরা বাকারা/২ : ২৭৫)
ব্যাখ্যা: সুদ খাওয়া বড়ো (মূল) নিষিদ্ধ কাজ। তাহলে এ আয়াতের আলোকেও সাধারণভাবে বলা যায়- কুরআনে উল্লিখিত মূল নিষিদ্ধ বিষয়ের একটিও পালন করলে বা মূল করণীয় বিষয়ের একটিও পালন না করলে মানব জীবন শতভাগ ব্যর্থ হবে।
অনুবাদ: আর যে (মু’মিন) ব্যক্তি (মিরাস বণ্টনের ব্যাপারে) আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্য হবে এবং তার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন, সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং তার জন্য রয়েছে অপমানকর শাস্তি। (সুরা নিসা/৪ : ১৪)
ব্যাখ্যা: মিরাস বণ্টন একটি মূল করণীয় কাজ। তাহলে এ আয়াতের আলোকে সাধারণভাবে বলা যায়- কুরআনে উল্লিখিত মূল করণীয় বিষয়ের একটিও পালন না করলে বা মূল নিষিদ্ধ বিষয়ের একটিও করলে মানব জীবন শতভাগ ব্যর্থ হবে।
সম্মিলিত শিক্ষা : ৭নং তথ্যের আয়াতসমূহের আলোকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় – মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় বিভাগের যে বিষয়গুলো কুরআনে উল্লেখ আছে তার সবগুলো পালন করতে হবে। (চলবে)
লেখক : কুরআন গবেষক, ল্যাপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন এবং চেয়ারম্যান, কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন