সাতক্ষীরা প্রতিনিধি- ১০ বছর আগে এক একর খাসজমির বন্দোবস্ত পান সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ভবতোষ কুমার সরকার। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই জমির দখল পাননি তিনি। মাঝে মধ্যে স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করলে বলা হচ্ছে— অপেক্ষা করুন। নদীভাঙনের শিকার সিদ্দিক উল্যা। বাস্তু হারিয়ে বসতি গড়েন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী গ্রামের এক চিলতে খাসজমিতে। প্রায় ২০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে ওই জমিতেই বাস করছেন তিনি। ২০ হাজার টাকা খরচ করে সম্প্রতি বন্দোবস্ত পেলেও কিছু অংশ আবার বেদখল হয়ে গেছে।
একই উপজেলার চরএলাহী ইউনিয়নের চরকলমি বিশ্ববেড়ির পাশে একটি খুপরি ঘরে সাড়ে ১৩ বছর ধরে বাস করছেন আনোয়ার হোসেন। জমি বন্দোবস্ত পেতে অসংখ্যবার তহসিল অফিসে গেছেন। টাকাও খরচ করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত জমির বন্দোবস্ত পাননি। অথচ তার চোখের সামনেই খাসজমিতে একের পর এক গড়ে উঠেছে মত্স্য খামার; যার মালিক স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ চিত্র কেবল নোয়াখালী বা সাতক্ষীরার নয়, দেশের প্রায় সব জেলা-উপজেলার। খাসজমি প্রাপ্য হলেও ভূমিহীনরা তা পাচ্ছেন না। অনেকে জমি বন্দোবস্ত পেলেও দখল নিতে পারছেন না। কেউ কেউ দখল পেলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। প্রাপ্য না হয়েও খাসজমি ভোগ করছেন প্রভাবশালীরা।
যোগাযোগ করা হলে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন খাসজমি কেউ বরাদ্দ পেয়ে থাকলে তার দখল যাতে বুঝে পান, সব জেলা প্রশাসককে সে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা ভূমি অফিসকেও বিষয়টি তদারক করার এখতিয়ার দেয়া রয়েছে। খাসজমির সুষ্ঠু বন্দোবস্তে ১৯৯৭ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুযায়ী, শুধু ভূমিহীন পরিবারই খাসজমি বরাদ্দ পাওয়ার অধিকারী। প্রতি একর বা তার অংশের জন্য ১ টাকা প্রতীকী মূল্যে ৯৯ বছরের জন্য এসব জমি বন্দোবস্ত পাবেন ভূমিহীনরা। ৯৯ বছরের আগে এ জমি কোনোভাবেই বিক্রি বা হস্তান্তর করা যাবে না।
ভূমিহীন পরিবার বলতে কৃষির ওপর নির্ভরশীল কৃষিজমিহীন পরিবারকে বোঝানো হয়েছে নীতিমালায়। এছাড়া বসতভিটাহীন, দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও নদীভাঙন কবলিত পরিবারও ভূমিহীন পরিবার হিসেবে খাসজমির দাবিদার হবে। তবে জমি পাওয়া ব্যক্তি ভূমিহীন নয় প্রমাণ হলে বন্দোবস্ত বাতিল হয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের নীতিমালা অনুযায়ী সাতক্ষীরায় ২২ হাজারের মতো ভূমিহীন পরিবারকে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। যদিও এর বড় অংশই জমির দখল বুঝে পাননি। প্রকৃত ভূমিহীনদের বঞ্চিত করে প্রভাবশালীরাই খাসজমির দখল নিচ্ছেন। সাতক্ষীরা জেলা ভূমিহীন আন্দোলনের অন্যতম নেতা অ্যাডভোটে আবুল কালাম আজাদ বলেন, সাতক্ষীরার খাসজমি নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। জালিয়াতির মাধ্যমে একশ্রেণীর প্রভাবশালী প্রাপ্য না হয়েও দীর্ঘদিন ধরে খাসজমি ভোগদখল করছেন। যেসব জমি ভূমিহীনদের নামে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে, তারও অধিকাংশ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চিংড়িঘেরের ভেতরে রয়ে গেছে। ফলে ওইসব জমির দখল নিতে পারছেন না বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমিহীনরা।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, জেলার সাত উপজেলায় খাসজমির পরিমাণ ৩২ হাজার ৯১৩ একর। এর মধ্যে কৃষিজমি ১২ হাজার ৯৮৫ ও অকৃষি ১৯ হাজার ৯২৭ একর। চলতি মাস পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৫৭ একর জমি ১৬ হাজার ৯৮৮টি পরিবারের মধ্যে বন্দোবস্ত দেয়ার কথা জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছে। খাসজমি বন্দোবস্ত পাওয়াদেরই একজন জেলার তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামের রিজিয়া বেগম। তিন বছর আগে দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে তাকে। কিন্তু আজো দলিলভুক্ত জমির দখল বুঝে পাননি তিনি। একই অবস্থা জেলার হাজার হাজার দলিলগ্রহীতা ভূমিহীন পরিবারের। জানতে চাইলে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বলেন, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সাতক্ষীরার ভূমিহীনরা খাসজমি বন্দোবস্ত এখন বেশি পাচ্ছেন। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, গত অর্থবছর জেলার ৩৩৬টি ভূমিহীন পরিবারকে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে ৩৫০টি পরিবারকে।
দলিল পেলেও জমির দখল না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ-সংক্রান্ত সমস্যার কথা তাকে কেউ জানায়নি। তবে বুড়িগোয়ালিনী এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের কিছু সমস্যার কথা তাকে বলা হয়েছে। শিগগিরই এটা মীমাংসা হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া মৌজার প্রায় ৩০০ একর খাসজমি সম্প্রতি উদ্ধার করে নদীভাঙনের শিকার ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু তাতে আজো দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি ভূমিহীনরা। ওই জমিতে এখন চিংড়িঘের। এছাড়া ডুমুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন নদীর চর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। মাস ছয়েক আগে দখলদারদের চিহ্নিত করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও দুদিন পরই তা থমকে যায়।
জানতে চাইলে খুলনা জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল বলেন, জেলাসহ প্রত্যেক উপজেলায় ভূমি-সম্পত্তি জবরদখল উদ্ধার-সংক্রান্ত কমিটি রয়েছে। সব উপজেলা কমিটিই তৎপর নয়। খাসজমি অবৈধ দখলমুক্ত করতে জেলা ও বিভিন্ন উপজেলায় নিয়মিত অভিযান চলে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলায় কৃষি-অকৃষি মিলে খাসজমি রয়েছে মোট ২২ হাজার ৯৫ একর। এর মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ ২০ হাজার ৮৩৮ একর। এ শ্রেণীর ১৭ হাজার ৩২৮ একর জমি বিভিন্ন সময়ে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। অবৈধ দখলে রয়েছে ২৫৬ একর। উপজেলাওয়ারি ৫৩০ একর কৃষি খাসজমি রয়েছে রূপসা উপজেলায়। এছাড়া তেরখাদায় ৪৩৪, দীঘলিয়ায় ১৫৯, ফুলতলায় ২১, ডুমুরিয়ায় ৬ হাজার ৫৭৩, বটিয়াঘাটায় দুই হাজার, দাকোপে ৪ হাজার ৩১৯, পাইকগাছায় চার হাজার ও কয়রা উপজেলায় ২ হাজার ৭৮৯ একর কৃষি খাসজমি রয়েছে। অকৃষি খাসজমির মধ্যে খুলনা মহানগরীতে রয়েছে ২৩৩ একর, রূপসা উপজেলায় ২২২, দীঘলিয়ায় ৬৯৭, ফুলতলায় ৪০, ডুমুরিয়ায় ২৮, বটিয়াঘাটায় আট, দাকোপে ২০ ও কয়রা উপজেলায় ১৪ একর।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, কৃষি ও অকৃষি মিলে নোয়াখালীতে খাসজমি রয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার একর। এর মধ্যে নোয়াখালী সদরে রয়েছে ৯২৫, কবিরহাটে ৬৮৬, সুবর্ণচরে ৫৭ হাজার, বেগমগঞ্জে ৭৭৩, সেনবাগে ১৩৬, কোম্পানীগঞ্জে ২৪ হাজার ও হাতিয়ায় ৭০ হাজার একর। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও হাতিয়ায় নদীতটে জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শুধু সুবর্ণচরেই মত্স্য খামারের নামে প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করে রেখেছে ২ হাজার ২৩ একর খাসজমি। দখলদারদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও ব্যবসায়ী গ্রুপও রয়েছে। প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে এ জমি বরাদ্দের নিয়ম থাকলেও এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটছে।
জানা যায়, সুবর্ণচর উপজেলার মোহাম্মদপুর, পূর্ব চরবাটা, চরবাটা, চর জুবলী, চর লক্ষ্মীসহ প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে কয়েক হাজার ভূমিহীন পরিবার খাসজমিতে ১০-১৫ বছর ধরে বাস করছে। খাসজমির বন্দোবস্ত চেয়ে তারা আবেদনও করেছেন। কিন্তু জমির বন্দোবস্ত হয়ে গেছে অন্য কারো নামে। কেউ কেউ বন্দোবস্ত পেলেও বুঝে পাচ্ছেন না দখল। সিলেট জেলায় খাসজমি রয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৯৯ একর। এর মধ্যে কৃষি খাসজমি ৪৯ হাজার ৯৪২ ও অকৃষি খাসজমি ৬৯ হাজার ৭৫৭ একর। কৃষি খাসজমির মধ্যে বন্দোবস্তযোগ্য জমির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৬৩৬ একর ও অকৃষি ১৫ হাজার ৩৪ একর। তবে প্রকৃত ভূমিহীনদের বাদ দিয়ে প্রভাবশালীদের নামে খাসজমি বন্দোবস্ত দয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে সিলেটের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, সিলেটে সড়কের পাশের খাসজমি দখল করে নেয়ার একটি প্রবণতা আছে। জবরদখলের অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।