কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম, রংপুর- রেড ক্লিফটের বদন্যতায় ৬৮ বছর পূর্বে ভারত পাকিস্থান ভাগাভাগির সময় উত্তরাধিকার সূত্রে ছিটমহল পেয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান তথা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারত। বাংলাদেশে ৪টি জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও নীলফামারীতে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি তথা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ ও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ৩১ জুলাই মধ্য রাতে মুক্তির আনন্দ বার্তা প্রতিধ্বনিত হয় ছিটবাসীরা মুখে মুখে, ‘আমরা সবাই বাংলাদেশি’। ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনা ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখেন সেখানকার জনগোষ্ঠিরা। ৬৮ বছরের না পাওয়ার গ্লানি, বঞ্চনার অবসান হয়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেন, কৃষি নির্ভর এ জনগোষ্টিকে উন্নয়নের পথে পরিচালনার জন্য দরকার কার্যকরী কৃষি পরিকল্পনা। দীর্ঘকাল বঞ্চিত এ মানুষগুলোর জীবন জীবিকার জন্য কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমান সময়ে কৃষিতে অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নেয়ার জন্য সদ্য বাংলাদেশের সাথে একত্রিভূত ছিটমহলগুলোতে নিতে বিশেষ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা। পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে ইতিমধ্যে জড়িপ কাজ সম্পাদন করেছে।
লালমনিরহাট জেলাতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছিটমহল একত্রিভূত হয়েছে। এ জেলায় মোট ৫৯টি ছিটমহল ছিল। তারমধ্যে পাটগ্রাম উপজেলায় সর্বোচ্চ ৫৫টি, সদর ও হাতিবান্ধা উপজেলায় ২টি করে। ছিটহমলগুলোর আয়তন ১,৩১১.১৯ হেক্টর, এর মধ্যে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১,১৭৬.৪০ হেক্টর। মোট জনসংখ্যা ১০,৩৭৭ জন, তারমধ্যে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ২,০৭২টি।
কুড়িগ্রাম জেলায় একত্রিভূত হয়েছে ১২টি ছিটমহল। ভূরুঙ্গামারীতে ১০টি, সদর ও ফুলবাড়ীতে ১টি করে। ভূরুঙ্গামারীতে একত্রিভূত হয়েছে কুড়িগ্রামের সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাশিয়ার ছড়া যার আয়তন ৬৬৫.৩৬ হেক্টর। আর কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ডাকুরহাট ডাকিনির কুঠি ছিটে কোন বসতবাড়ি ছিল না। সব মিলে মোট আয়তন ৭৫৫.৬৫ হেক্টর। মোট জনসংখ্যা ৮,১৩২জন এবং কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১,৬৩০টি। উত্তরের সর্বশেষ জেলা পঞ্চগড়ে একত্রিভূত হয়েছে ৩৬টি ছিট ও ছিটমহল। দেবীগঞ্জে ৬টি, বোদায় ৪টি এবং সদরে ১টি ছিটমহল এবং বাকিগুলো ছিট হিসেবে পরিচিত যেখানে কোন জন বসতি নেই। সব মিলে আয়তন ৪০৯৬.০৫ হেক্টর। জনসংখ্যা ২০,০৭১ জন ও কৃষক পরিবার রয়েছে ৪,৪৪৫টি। সবচেয়ে কম সংখ্যক ছিটমহল ছিল নীলফামারীতে মাত্র ৪টি। সবগুলো ছিটমহলই ডিমলা উপজেলায় অবস্থিত। ছিটমহলগুলোর মোট আয়তন ৬৯.২৪ হেক্টর; এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫৩.৮৮ হেক্টর। মোট জনসংখ্যা ২৬৪ জন এবং কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১২৬টি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট চার জেলার উপপরিচালকগণ বলেন, জড়িপ পর্যালোচনা শেষে বাস্তবতার নিরিখে স্ব স্ব জেলায় কার্যকর পরিকল্পনাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। তারা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য কৃষক প্রশিক্ষণ; মৌসুম ব্যাপি হাতে কলমে শিক্ষার জন্য কৃষক মাঠ স্কুল গঠন; বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ কর্মসূচি গ্রহণ, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও উর্ব্বরতা বৃদ্ধিকল্পে কম্পোষ্ট, কুইক কম্পোষ্ট, ভার্মিকম্পোষ্ট, খামারজাত সার, সবুজ সার প্রস্তুত প্রণালী ও এর ব্যবহার নিশ্চিতকরণ; বিভিন্ন ফসলের আধুনিক জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে প্রদর্শনী স্থাপন; পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য বসতবাড়িতে সবজি বাগান স্থাপন; পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও আয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ফলের (আম, কাঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, পেঁপে ইত্যাদি) বাগান স্থাপন; বিভিন্ন ফসলের বীজ ও সারের চাহিদা নিরূপণ পূর্বক সরবরাহ নিশ্চিতকরণ; সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য নতুন করে গভীর ও অগভীর নলকূপের সংখ্যা নিরূপণ পূর্বক স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রতিটি কৃষক পরিবারের জন্য কৃষি কার্ড সরবরাহ ও ১০/- টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা গ্রহণ; বিভিন্ন মৌসুমে প্রনোদনা কর্মসূচির মাধ্যমে বীজ, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণাদির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ; কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কৃষি যন্ত্রপাতি সহজ শর্তে সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ; মৌসুম ভিত্তিক বিভিন্ন ফসলের উপর সহজ শর্তে কৃষি ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ; কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ; এছাড়াও মাঠ দিবস, চাষি র্যালী, ভ্রাম্যমাণ সিনেমা প্রদর্শনী ও দলীয় আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে আধুনিক কৃষি উৎপাদনে কৃষকদেরকে উৎসাহিতকরণের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। তারা আরও বলেন এসব পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে কৃষিতে কাঙিক্ষত পরিবর্তন আসবে। ইতিমধ্যে সরকার সদ্য একত্রিভূত ৬৯৪৬.৫৬ হেক্টর আয়তনের ছিটবাসীদের উন্নয়নের জন্য ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুড়িগ্রাম জেলার উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শওকত আলী সরকার বলেন, বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। এ জন্যে তিনি এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি তথ্য সার্ভিসের উদ্যোগে অবাধ কৃষি তথ্য সেবা কৃষকের গোড়দোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্যে ‘কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র’ স্থাপনের কথা উল্লেখ করেন। পাটগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. নূর আলমের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি তার উপজেলায় ইনোভেশন সার্ভিস প্রকল্প হতে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এলাকার ফসলের উপযোগিতা ও জমির ধরণ বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন। বঞ্চিত ও পিছিয়ে পরা এ জনগোষ্ঠি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি যত দ্রুত গ্রহণ করতে পারবে তাদের উন্নতি তত ত্বরাণি¦ত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পাটগ্রামের বাঁশকাটা ছিটের কৃষক হাফিজুর রহমান, রমজান আলী, বাবুল হোসন প্রমুখ বলেন পূর্র্ব পুরুষদের শিখিয়ে দেয়া পদ্ধতিতে তারা এতদিন ধান, ভূট্টা, আলু, বেগুন, মরিচ, শাক-সবজি চাষ করত। সে সময় তারা গোপনে স্থানীয় বাজার হতে প্রতিবেশি বাংলাদেশিদের সহায়তায় সার-বীজ সংগ্রহ করতেন।
বর্তমানে তারা ফসল চাষে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ-পরামর্শ, সেচ-সার-বীজ-বালাইাশক, সহজ শর্তে কৃষি ঋণ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও ভর্তুকি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।