অগ্রসর রিপোর্ট : খামারিরা কোরবানি উপলক্ষে গরু মোটাতাজাকরণ করে হাটে তোলার জন্য প্রস্তুত থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে চিন্তিত তারা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গত বছরের চেয়ে এবার অন্তত ১৫ শতাংশ কোরবানি কম হবে। তেমনটি হলে খামারিরা তাদের সারা বছরের বিনিয়োগ আর শ্রম লোকসানে পড়বে বলে শঙ্কায় আছেন।
তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হাটের পাশপাশি অনলাইনে পশু বিক্রির দিকে মনোযোগ দিলে খামারীদের লোকসানের শঙ্কা কাটানো যেতে পারে। এ জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের সংযোগ ঘটিয়ে দেবে।
গত বছর দেশে ১ কোটি ৬ লাখের মতো গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল। সাধারণত প্রতি বছর চাহিদা বাড়ে পাঁচ শতাংশ। সেই হিসাবে এবার ১ কোটি ১০ লাখের মতো চাহিদার বিপরীতে কোরবানিযোগ্য পশু আছে ১ কোটি ১৯ লাখ।
কিন্তু এবার করোনার সংকটে কোরবানির সংখ্যা কমে যাবে বলে মনে করছেন খামারিসহ এই খাতের সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি মহল। এই আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে কোরবানির পশু অনলাইনে বিক্রি করার জন্য জোর দিয়েছেন অনেকে। সরকারও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা অনলাইনে দক্ষ নন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অনলাইন প্লাটফর্মে যারা পশু বিক্রি করবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দিচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের।
ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ইমরান হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মাংসের চাহিদা এমনিতেই অনেক কমে গেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গরু-ছাগলের চাহিদা থাকতো। এখন অনুষ্ঠান নেই, সে চাহিদাও নেই। এই সময়ে কারও বিয়ের অনুষ্ঠান হলেও, তাতে সীমিত পরিসরে আয়োজন থাকছে। পশু জবাই করে আপ্যায়নের মতো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। ফলে খামারিদের হাতে গত বছরের চেয়ে বেশি গরু অবিক্রীত রয়েছে।
এসব গরু বিক্রি নিয়ে শঙ্কায় আছেন জানিয়ে ইমরান হোসেন বলেন, ‘এত শ্রম আর খরচ করে সারা বছর আমরা পশুগুলো লালন-পালন করেছি। বিক্রির প্রধান মৌসুম কোরবানির সময় বিক্রি করতে না পারলে অনেক ক্ষতির মুখে পড়ব।’
সাদেক অ্যাগ্রোর মালিক মো. ইমরান হোসেন। তার খামারের গরু অনলাইনে বেশ বিক্রি হয়। সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি পেরেছি, কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা কিন্তু অনলাইনে তাদের পশু ভালোভাবে তুলে ধরতে পারে না। এ বিষয়ে তারা এখনো দক্ষ হয়ে ওঠেনি। অনলাইনে গরুর বিক্রি করতে হলে তার ওজন জানিয়ে দিতে হয়। ভালো ছবি যুক্ত করতে হয়। আবার ভিডিও দিতে হয়। এগুলো এখনো বুঝে উঠতে পারেনি প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (খামার) ড. এ বি এম খালেদুজ্জামান ঢাকাটাইমকে বলেন, গত বছর কোরবানিযোগ্য পশু অবিক্রীত থেকেছিল ১০-১১ লাখের মতো। এবার ১ কোটি ১০ লাখ গবাদিপশুর চাহিদা থাকার কথা। কিন্তু করোনার কারণে অর্থসংকট ও স্বাস্থ্যগত শঙ্কায় কোরবানির পশুর চাহিদা অত হবে না। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কোরবানি কমে যেতে পারে।
গতবারের চেয়ে এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেড়েছে জানিয়ে সহকারী পরিচালক বলেন, গত বছর ছিল এক কোটি ১৭ লাখ ৮৮ হাজার। এবার গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ অন্যান্য পশু মিলিয়ে ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি কোরবানির পশু রয়েছে। এর মধ্যে হৃষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষ ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার এবং ছাগল-ভেড়া ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ও দুম্বাসহ অন্যান্য পশু আছে ৪ হাজার ৫০০টি।
খমারেদের তাদের পশু অনলাইনে বিক্রিতে উৎসাহিত করা হবে জানান ড. এ বি এম খালেদুজ্জামান। বলেন, যারা অনলাইন প্লাটফর্মে পশু বিক্রি করবে, ডেইরি ফার্ম আছে, ই-ক্যাব আছে, তাদের সঙ্গে খামারিদের সংযোগ ঘটিয়ে দেবেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রিজনাল অফিসার। অনলাইন প্লাটফর্মে যাতে বিক্রি বেশি হয় সে বিষয়ে আমরা উৎসাহিত করব।’
করোনার এই সংকটের সময়ও ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে কোরবানি ও কোরাবানির পশু বিক্রি বাদ দেয়া যাবে না বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, হাট বসিয়ে পশু বিক্রির ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বাস্তবায়ন অসম্ভব।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কোভিট-১৯ সংক্রমণের যে সূচক, তা কয়েক দিন ধরে নিম্নমুখী। গরুর হাট শুরু হলে এটা আবার ঊরধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
পশুর হাট এভাবে না বসিয়ে অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা কিংবা কিছু প্রাইভেট কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া যেত বলে মনে করেন ডা. লেলিন চৌধুরী। এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গরুর একটা দাম ফিক্সট করে সবাইকে তা জানিয়ে দেওয়া যায়। এরপর সরকার বিক্রীত পশু ক্রেতার বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। এটা খুব কঠিন হতো তা না। খামারিদের সঙ্গে এ বিষয় সমন্বয় করলেই হতো।’
এ বছর কোরবানির পশু বিক্রি কম হবে বলে আশঙ্কা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদের। কোরবানির পশু নিয়ে খামারিরা যেন বিপাকে না পড়ে সেদিকে সরকারের নজর চান তিনি।
ড. নাজনীন বলেন, ‘আবার কোরবানির পশু ঘিরে করোনার সংক্রমণ যেন না ছড়ায় সে বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে। প্রতি উপজেলায় কোথায় কেমন কোরবানির পশু চাহিদা হয় সেটি সরকার জানে। তাই চাহিদা ও জোগানের বিষয় যেন ঠিক থাকে। প্রয়োজনে খামারিদের সঙ্গে উপজেলাভিত্তিক যোগাযোগ করতে হবে। প্রতি উপজেলায় তিন থেকে চারটার বেশি পশুর হাট যেন না বসে।
গরু কিনতে এক উপজেলার লোক অন্য উপজেলায় যেতে পারবে না এমন নিয়ম করা যেতে পারে। ড. নাজনীন বলেন, গ্রাম থেকে শহরে কত গরু টুকছে তার হিসাব যেন সরকার সঙ্গে সঙ্গেই পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা শহরে কোন এলাকার হাটে কোন এলাকার লোক যাবে এটা ঠিক করে দিতে হবে। যার যার কাছাকাছি হাটে সে যাবে।
ক্রেতাদের উদ্দেশে ড. নাজনীনের পরামর্শ, এবার গরু কেনার জন্য হাটে হাটে না ঘুরাই ভালো হবে। পরিকল্পনা করে কাছাকাছি কোনো একটি হাটে গিয়ে কোরবানির পশুটি কিনে নিন।
করোনা সতর্কতার জন্য হাট কর্তৃপক্ষ হাটে যেন স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করে। আর শহরে যারা আছে তারা অনলাইন থেকেই কোরবানির পশু কিনে পারেন। ড. নাজনীন বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা সব প্রিপেয়ার করে বাসায় কোরবানির মাংস দিয়ে যাবে।