সমন্বয়হীনতা এবং ভালো বীজের অভাবে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা উন্নতি করতে না পারায় প্রচলিত বীজ নীতি ও আইন যুগোপযোগী করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে বীজ অধ্যাদেশ-১৯৭৭, বীজ (সংশোধনী) আইন ১৯৯৭ এবং বীজ (সংশোধনী) আইন ২০০৫ পর্যালোচনা করা হবে। পুরোনো এসব আইন বর্তমান সময়ের জন্য কতটা কার্যকর, তা খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি বীজ ডিলার নিবন্ধন ও নবায়ন ফি জমাদান পদ্ধতিও আরো সহজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২৫ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে কৃষি মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। সভায় সভাপতিত্ব করবেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক।
প্রচলিত বীজ নীতি ও আইনকে বাস্তবসম্মতভাবে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সভায় সংশ্লিষ্ট মতামত গ্রহণ এবং পর্যালোচনা করা হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে আনোয়ার ফারুক রাইজিংবিডিকে বলেন, বর্তমানে বীজ খাতে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবে এ খাতে সম্ভাবনাও কম নয়। এ জন্য বীজ নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। যেখানে কৃষকের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তেমনি বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপও থাকছে।
তিনি বলেন, কৃষক বিভিন্ন সময়ে মানহীন বীজের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন, সেটা যেমন কমিয়ে আনা হচ্ছে তেমনি বীজ রপ্তানির সুযোগও সৃষ্টি করা হচ্ছে। তবে সবকিছুই বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে না। তারা এখনো শতভাগ আস্থা তৈরি করতে পারেনি। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাস্তবায়ন পর্যায়ে বেশ কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। সেগুলো কমিয়ে আনা হবে।
কৃষিবিদদের মতে, বীজ কৃষির প্রাণ। বীজের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা তথা খাদ্যনিরাপত্তাও তার হাতে থাকবে। কাজেই বীজ শুধু কৃষকের জন্যই নয়, গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
সূত্রমতে, একসময় বীজের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে কৃষকের হাতেই ছিল। কিন্তু বর্তমানে কৃষক বীজের জন্য ক্রমেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কারণ, ফসলি জমি সংকুচিত হয়ে আসার কারণে নিজেরা বীজ উৎপাদন করার পরও বীজের চাহিদা থাকে কৃষকদের।
বর্তমানে কৃষকরা চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৫৪ শতাংশ ধানের বীজ নিজেরা উৎপাদন করে থাকে। এ ছাড়া মাত্র ৩৫ শতাংশ গমবীজ, ৬ শতাংশ ভুট্টা, ২৯ শতাংশ আলু, ৫ শতাংশ পাট, ৭২ শতাংশ ডালজাতীয় ফসল, ৬৬ শতাংশ তেলজাতীয় ফসল, ৫৭ শতাংশ মসলাজাতীয় ফসল এবং ৩৬ শতাংশ শাকসবজির বীজ নিজেরা উৎপাদন করে। বাকি বীজের জন্য তারা বাজারের ওপর নির্ভরশীল।
এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর সাড়ে ১১ লাখ টন বীজের চাহিদা রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চাহিদার মাত্র ২৩ শতাংশ বা ২ লাখ ৬৩ হাজার টন বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে।
এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) মাত্র দেড় লাখ টন এবং বাকি বীজ দেশের ১৭৬টি কোম্পানির মাধ্যমে জোগান দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সারা দেশে ৪০ লাখ পাটচাষির জন্য পাটবীজের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ টন। কিন্তু সরকারিভাবে চাহিদামাফিক বীজ সরবরাহ করা যায় না। এই অবস্থায় প্রচলিত বীজ নীতি যুপোগযোগী করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে কৃষক সময়মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসম্মত বীজ পায় না। এ ছাড়া বাজার নির্ভরশীলতার ফলে কৃষককে নানাভাবে প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। একদিকে যেমন তাদের বীজের অত্যাধিক মূল্য গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে নিম্নমানের বীজ চাষ করে অনেক ক্ষেত্রে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকদের এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষকনিয়ন্ত্রিত বীজ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এ ছাড়া উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম জোরদার করা এবং বিএডিসি ও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিকে শক্তিশালী করতে হবে।