রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে সম্ভবত দু’টি ভবিষদ্বাণী করা সম্ভব। প্রথমত, তিনি রাশিয়ার চলমান নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি একদিন মারা যাবেন। তবে পুতিনের স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় পুতিন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে পারে। তবে সেই দিনটি কবে আসবে, তা কারও জানা নেই। এজন্য বিশ্বকে পুতিনের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া ক্ষমতা দখলের লড়াই দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে।
২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পুতিন বিজয় নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনে জালিয়াতির সকল পথ তৈরি করে রাখতে শুরু করেন। ভোট ক্রয়, গণনায় কারচুপি, ব্যালট বাক্সে কারচুপি, ভোটারদের পর্যবেক্ষণ ও ভয় দেখানোর মতো পদ্ধতি পুতিনের এজেন্টরা ভোটের ফলাফল তাদের পক্ষে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে।
পুতিন তার রাজনৈতিক বিরোধীদের জেলে পাঠিয়েছেন। আর অন্যদের নির্বাসিত করেছেন। বরিস নেমতসভের মতো বিরোধী ব্যক্তিদের হত্যা এবং সম্প্রতি কারাগারে আলেক্সি নাভালনির মৃত্যুতে পুতিনের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
পুতিন ক্ষমতা ছাড়লে কী হবে?
পুতিন ক্ষমতা ছেড়ে দিলে স্বাভাবিকভাবেই তার উত্তরসূরি আসবেন। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট যতদিন জীবিত থাকবেন তার ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব ও প্রভাব ওই উত্তরসূরির জন্য হুমকি হয়ে থাকবে। এটা পুতিন ও তার উত্তরসূরি দু’জনই জানেন।
অধিকাংশ স্বৈরশাসক তাদের উত্তরসূরির নাম প্রকাশ্যে আনেন না। কারণ, তাদের অবসর বা মৃত্যুর আগেই বিষয়টি নিয়ে তিক্ত ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে। ঠিক তেমনি পুতিন যদি তার উত্তরসূরি বাছাই করেন, সেই ব্যক্তি অবিলম্বে অন্যদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে।
পুতিনের অভ্যন্তরীণ মিত্রদের মধ্যেও তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। তবে পুতিন নানা কৌশলে এসব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। অবশ্য রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের ২০২৩ সালের বিদ্রোহ দেখিয়েছে, এসব প্রতিযোগিতা কতটা মারাত্মক হতে পারে।
প্রিগোজিন ২০২৩ সালের আগস্টে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন, যার মূল কারণ হয়তো কখনও জানা সম্ভব হবে না। তবে এ ঘটনায় পুতিনের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুতিনের অপসারণের সম্ভাবনা নেই। কারণ, রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর পুতিনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। পুতিন তার শাসনামলে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সম্ভাব্য হুমকি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তার শাসন অনেকটাই অভেদ্য প্রমাণ করেছেন।
এ ছাড়া পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব রাশিয়ান জাতীয়তাবাদের চর্চা পুতিনকে সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের আনুগত্য অর্জনে সহায়তা করেছে।
পুতিন তার অলিগার্কদের (রুশ ধনকুবের) অনুগত রাখতে রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল, গ্যাস, খনিজ এবং শিল্প উৎপাদকদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কোন অলিগার্ক নিয়োগ করা হবে, তার সিদ্ধান্ত পুতিন নিজে নেন। যতক্ষণ তারা পুতিনের প্রতি অনুগত না থাকেন এবং তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশকে সমর্থন না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অলিগার্কদের আয়ের কোনো সুযোগ নেই।
অলিগার্কদের সম্পদ এবং স্বাধীনতা পুতিনের অনুগ্রহে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। পুতিনকে অতিক্রম করলে তারা সবকিছু হারাতে পারেন। টাইকুন মিখাইল খোডোরকভস্কি ২০০৩ সালে পুতিনের সমালোচনা করার পর বন্দি হয়েছিলেন এবং তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘ইউকোস’কে রাষ্ট্র কর্তৃক জব্দ হতে দেখেছিলেন। অর্থাৎ, পুতিনের জোট থেকে সরে আসা রাশিয়ান অভিজাতদের কিছু পাওয়ার বা হারানোর নেই।
পুতিনের মৃত্যুর পর কী হবে
রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে অথবা মারা গেলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হবেন। ২০০০ সালে বরিস ইয়েলতসিনের পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে এটাই ছিল পুতিনের প্রথম পদক্ষেপ।
রাশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন একজন নমনীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সাবেক এই কর কর্মকর্তার নিজের তেমন শক্তিশালী ভিত্তিও নেই। তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুতিনের স্থলাভিষিক্ত হলেও তিনি যে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না- তা একরকম নিশ্চিত।
রুশ সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির মৃত্যু বা দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার ৩ মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষমতা দখলের আসল লড়াইটা হবে পর্দার আড়ালে, ব্যালট বাক্সে নয়।
নির্বাচনের আগে ক্ষমতা দখলের সম্ভাব্য লড়াই হয়তো সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু একজন শাসকের জন্য পুতিনের রেখে যাওয়া ক্ষমতা সুসংহত করতে ৩ মাস যথেষ্ট সময় নয়। এটা তখনই সম্ভব যখন প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে, যা কয়েক বছর ধরে প্রচলিত থাকতে হবে। অথবা, একটি অনানুষ্ঠানিক জোট প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো ভাগাভাগির মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে দেশ শাসনের চেষ্টা করবে। রাশিয়ায় এ ধরণের ক্ষমতা ভাগাভাগির ঐতিহাসিক নজির রয়েছে। ভ্লাদিমির লেনিন এবং জোসেফ স্ট্যালিন উভয়ের মৃত্যুর পর ‘সম্মিলিত নেতৃত্ব’ঘোষণাকারী জোটগুলো রাশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল।
তবে পুতিন মারা যাওয়ার পরের দিন, মাস ও বছরগুলো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। সোভিয়েত সময়ের পর থেকে একক শক্তিশালী শাসক হিসেবে পুতিনের বিকল্প কেউ নেই। একা হাতে এবং সামান্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় নেতৃত্বে পুতিন রাশিয়ায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন, তা রোমানদের ইতিহাসের মতো সাফল্যমণ্ডিত।