টিভি, রেডিও, গান বাজনা হলো খিস্টান আর ইহুদীদের লাগি, মুসলমানদের লাগি না। আজকাল তো হিন্দু-মুসলমনের কোন ভেদাভেদ নাই, মুসলমানোর পুরি (মেয়ে) হিন্দুদের মতো টিপ আর চুড়ি পরে।’- হরিপুর বাজারে বসে চা খেতে খেতে বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জাতীয় পার্টি নেতা সাহাব উদ্দিন বললেন এমন কথা। সাহাব উদ্দিনের কথায় সায় দিলেন পাশে বসা আরো কয়েকজন। পুরো ইউনিয়ন ঘুরে প্রায় একই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেলো।
হরিপুর ইউনিয়নে (পূর্বে এটি ফতেহপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল) প্রকাশ্যে টিভি দেখা নিষেধ। একই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রেডিও শোনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপরও। খেলাধুলার উপরও নিষেধাজ্ঞা এককালে ছিলো, তবে ইদানীং নানা কারনে তা শিথিল করা হয়েছে। পুরো ইউনিয়নবাসীর মিলনক্ষেত্র একটামাত্র বাজার। বাজারের নাম হরিপুর বাজার। এই বাজারে কেউ লুকিয়েও টিভি কিংবা রেডিও শুনলে তার শাস্তি অবধারিত। হরিপুর বাজারের পাশেই দেশের অন্যতম গ্যাস ক্ষেত্র হরিপুর গ্যাস ফিল্ড, তার পাশেই বিশাল চা বাগান, এই সড়ক দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই জাফলং পাথর কোয়ারি, জৈন্তাপুরের খাসিয়াপুঞ্জি। স্বভাবতই এসব স্থানে আবাস গেড়েছেন নানা অঞ্চলের, নানা বিশ্বাসের মানুষ। মানুষের এই বৈচিত্রও বদলাতে পারে নি বিচিত্র এই আইন।
আইন বলতে আসলে তেমন কিছৃু না। স্থানীয় এক মৌলানা, লোকে যাকে পীর সাহেব বলে, নাম শায়েখ আব্দুল্লাহ। তিনি মৌখিকভাবে ধর্মগ্রন্থের কথা উল্লেখ করে এই নিষাধাজ্ঞাটা জারি করেন। তারপর থেকেই এলাকার সবাই তা মেনে আসছে। আর যারা নিষাধাজ্ঞা অমান্য করেছে তাদের উপর খড়গহস্ত হওয়ারও নজির রয়েছে। কবে থেকে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এ ব্যাপারে কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু না বলতে পারলেও এলাকাবাসী পায় সকলেরই অভিন্ন মত, ‘শায়েখ সাহেব মাদ্রাসাটা প্রতিষ্টা করার পরপরই’। শায়েখ আব্দুল্লাহ হরিপুর বাজারে ‘জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসাতুল উলুম দারুল হাদিস’ নামক মাদ্রাসাটি প্রতিষ্টা করেন ১৯৮১ সালে। শায়েখ আব্দুল্লার মৃত্যুর পর এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রাখার দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত।
এই ইউনিয়নের হরিপুর বাজারে পৌঁছার প্রায় এক কিলোমিটার আগে রাস্তার পাশেই চোখে পড়বে একটা সাইনবোর্ড। যাতে বড় বড় করে লেখা- ‘মাইক বাজানো নিষেধ’। এই সড়ক দিয়ে জাফলং, শ্রীপুর, লালাখাল, জৈন্তাপুরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন শত শত লোক ঘুরতে যায়। মাইক বাজিয়ে পিকনিকে যায় অনেকে। কিন্তু এই সাইনবোর্ড দেখার সাথেসাথেই মাইক বন্ধ করে দিতে হবে। নতুবা হরিপুর বাজারে গাড়ি থামিয়ে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হবে। ঠিক আবার উল্টোদিক থেকে আসতেও একই রকম সাইনবোর্ড চোখে পড়বে।
এই ইউনিয়নের ভোটার সংখ্যাই প্রায় ১৫ হাজার। ইউনিয়নের সর্বত্র টিভি, রেডিও’র উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা সাম্প্রতিককালে ততোটা কার্যকর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কেউ ঘরের ভিতরে লুকিয়ে টিভি দেখলে ইদানীং আর তেমন বাঁধা দেন না পঞ্চায়েতরা। তবে শর্ত হলো অবশ্যই তা লুকিয়ে দেখতে হবে। এবং যে বাড়িতে এগুলো দেখা হবে সেই বাড়ির পাশের রাস্তা থেকে যেনো টিভি বা রেডিও’র শব্দ কোনভাবেই শোনা না যায়। তাতে পথিকদের পথভ্রষ্ট ও গুনাগার করে ফেলার অপরাধে শাস্তি ভোগ করতে হবে। এছাড়া প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পূর্বে এলাকার মসজিদগুলোতে রেডিও, টিভি দেখা ও শোনার কুফল সম্পর্কে মৌলানারা খুতবা পড়েন। এবং এই পাপের ফলে মৃত্যু পরবর্তী আজাব সম্পর্কেও একটা ধারনা দেবার চেষ্টা করেন।
হরিপুর বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, শায়েখ আবদ্দুল্লাহ বেঁচে থাকতে মকবুল নামক জনৈক ব্যবসায়ী বাজারে রেডিও বাজানোর অপরাধে এলাকার লোকজন তার দোকান কোঠা ভেঙ্গে ফেলে। এমনকি মকবুলের মৃত্যুর পর তার জানাযাতেও অংশ নেন নি এলাকাবাসীরা। সেসময় আরো দু’একজনকে এরকম শাস্তি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। তারপর থেকে বাজারে কেউ রেডিও পর্যন্ত বাজান না। এমনকি বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ও না। তবে গ্রামের তরুণরা ঠিকই বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে বিশ্বকাপ খেলা দখে আসেন।
এ ব্যাপারে হরিপুর বাজারের এক তরুন ব্যবসায়ী জানান, ‘টিভিতে খেলা দেখায় আসলে তেমন গোনা নাই, খেলার মাঝখানের নাটকগুলো কেবল না দেখলেই হবে।’
বাড়িতে লুকিয়ে টিভি দেখলে কেউ প্রকাশ্যে বাঁধা না দিলেও, যে পরিবারে টিভি আছে সে পরিবারের মেয়েকে এলাকার কেউ বিয়ে করতে চায় না বলে জানা গেছে। ইউনিয়বাসীদের অনেকের ধারনা, বাড়িতে থাকা টিভি দেখে দেখে বাড়ির মেয়েদের চরিত্রে কালিমা পড়েছে। এলাকাবাসীদের এমন বিশ্বাসের সত্যতা প্রমানের জন্য হাতের কাছে উদাহরণও পাওয়া গেলো।
বাজারের পাশেই একটি বাড়িকে দেখিয়ে এবং এই বাড়ির কর্তার নাম উল্লেখ করে স্থানীয় কয়েকজন জানালেন, এই ভদ্রলোকের তিনজন মেয়ে আছে, তিনজনই সুন্দরী। কিন্তু এই মেয়েদের জন্য কোন বিয়ের প্রস্তাব আসে না। বাজারের সবচেয়ে নিকটবর্তী বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাড়ি ডিঙ্গিয়ে অন্য বাড়ির মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। এলাকাবাসীদের ধারনা কেবলমাত্র বাড়িতে টিভি থাকার কারনে এ বাড়ির মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব আসছে না।
এমনিতে এই ইউনিয়নের মেয়েরা সামান্য যে লেখাপড়াটুকু করে তা মাদ্রাসাতেই সীমাবদ্ধ। এদের প্রথম শ্রেণী থেকেই বোরকা পড়তে হয়। আর যারা সাধারন স্কুলগুলোতে ভর্তি হয় তাদেরও অষ্টম শ্রেণীতে ওঠা মাত্রই বোরকা পড়া বাধ্যতামূলক।
এলাকার প্রবীণ এলাইছ মিয়া মেয়েদের লেখাপড়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জানান, ‘এলাকার কেউরই (কারোরই) পড়ালেখা হিকাইয়া পুরিরে (মেয়েকে) ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাইবার ইচ্ছা নায়। পুরিয়ে চাকরী করি ভাত খাবাইবার আশায় পুরিরে কেউ পড়ায় না।’
ইউনিয়নে সবধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। এই আইন অমান্যকারীকেও শাস্তি প্রদানের নজির রয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার অপরাধে শাস্তি প্রদানের কাহিনীটা শোনালেন খোদ শায়েখ আব্দুল্লাহ’র পুত্র শায়েখ হিলাল আহমদ। তিনি জানান, অনেক আগে একবার ইউনিয়নের চিকনাগুল এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো এলাকার উশৃঙ্খল যুবকেরা। আব্বা (শায়েখ আব্দুল্লাহ) গিয়ে তাদের বাঁধা দেন। কিন্তু আয়োজকরা এই বাধা না শুনে আব্বার সাথে বেয়াদবী করে। এতে এলাকার লোকজন ক্ষেপে যায়। ক্ষুব্দ এলাকাবাসীরা বেয়াদব ছেলেদের বাড়িঘরে হামলা চালায় ও তাদের এলাকা ছাড়া করে। পরবর্তীতে এলাকাবাসীদের শান্ত করতে এসপি সাহেব তাদের আশ্বাস দেন, আসামীদের আব্বার হাতে তুলে দেবেন এবং আব্বা তাদের যে শাস্তি দেবেন প্রশাসন তা মেনে নেবে। পরদিন ঠিকই এসপি সাহেব টিএনও সাহেবকে সাথে করে আসামীদের নিয়ে আব্বার কাছে আসেন এবং এই মাদ্রাসা মাঠে সবার সামনে আসামীদের দিয়ে আব্বার পায়ে ধরে মাফ চাওয়ান।
এই ঘটনাটা কবে ঘটেছিলো তা নির্দিষ্ট করে মরে করতে পারেন নি হিলাল আহমদ। ঘটনার তারিখ সম্পর্কে তার মন্তব্য, ‘আব্বা ইন্তেকাল করার বছর দেড়েক আগে’। শায়েখ আব্দুল্লাহ মারা গেছেন ১৯৯৮ সালে।
বাজারে মদ খাওয়ার জন্যও রয়েছে কঠোর শাস্তি। তবে তা প্রমানের বিধানটা অদ্ভূত। তিনজন স্বাক্ষী থাকতে হবে। এই অপারাধে অভিযুক্তকে প্রথমেই পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এরপর পঞ্চায়েতের বিচারে যে শাস্তি হয় তা মেনে নিতে হবে।
এ ব্যাপারে বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জাতীয় পার্টি নেতা সাহাব উদ্দিন জানান, বাড়িঘরে টিভি দেখলে আমরা নিন্দা করি আর বাজারে কেউ টিভি বা রেডিও বাজালে যে কোনদিন নামাজ পড়ে না সেও বাঁধা দিবে।
তিনি বলেন, আল্লার হাদিসে আছে, আমার এক ভাই যদি বেপথে চলে যায় তবে তাকে বুঝিয়ে সুপথে আনতাম, এতে কাজ না হলে প্রয়োজনে মারধরও করতাম। এই এলাকার মানুষজন খুব সুখে আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এসব বিষয় নিয়ে আলাপ হয় হরিপুর বাজার মসজিদের সাবেক ইমাম ও শায়েখ আব্দুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির শিক্ষক হাফিজ রহমত উল্ল্যার সাথে। তার কাছে টিভি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিরোধী কোরআন কিংবা হাদিসের আয়াতটি সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি হেসে এবং বিনয় সহকারে বলেন, আপনার তো অজু নাই, আপনি আয়াতটি লিখতে পারবেন না।
আয়াতটি না লেখার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি বলেন, কোরআন শরিফে আছে, যদি কেউ গান শুনে, খেলাধুলা করে তবে তাকে হাত দিয়ে প্রতিহত কর। সে শক্তি না থাকলে মুখ দিয়ে বাঁধা দাও, সে শক্তিও না থাকলে মন দিয়ে ঘৃণা কর। আবার হাদীস শরিফে নবীজী বলেছেন, যখন গানবাজনা, খেলাধুলা, বেপর্দা নারীর আনাগোনা বেড়ে যাবে তখন বুঝতে হবে কেয়ামত আসন্ন।
বাংলাদেশের অন্যান্যস্থানে এমনকি বিশ্বের সব মুসলিম দেশগুলোতে তো টিভি দেখায় কোন বাধা নেই তারপরও এখানে এই আইন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজোর এলাকারে সামটিয়া (সামলে) রাখা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।
কথা প্রসঙ্গে তার সাথে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কথা ওঠে। এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই ওঠে আসে জামায়াত ইসলামের নাম। এ প্রসঙ্গে রহমত উল্ল্যাহ বলেন, আমরা জামাতরে পছন (পছন্দ) করি না। তারা নিজেরাই নামাজ পড়ে না। এই এলাকার মুরব্বীরা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম করইন। মাদ্রাসায় একমাত্র আমরাই রাজনীতি করমু। ইনো জামাত খায় না।
এসব ব্যাপারে মাদ্রাসার সচিব সাহেব সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন জানিয়ে এরপর তিনি জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসাতুল উলুম দারুল হাদিসের পথে রওয়ানা হন। মাদ্রাসার সচিবকে পাওয়া না গেলেও দেখা মিলে এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও শায়েখ আব্দুল্লার পুত্র শায়েখ হিলাল আহমেদের সাথে।
টিভি দেখা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপর তার প্রয়াত পিতার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেকে মনে করেন আব্বার অবৈধ অস্ত্র ছিলো। তিনি জোর করে এইগুলা করছেন। আসলে আব্বা জনগনকে নিয়েই এই আইন করছেন। জনগন তাকে সম্মান করে। তাই তার কথা এখনো মেনে চলে।
স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য এমএ রকিব এলাকায় টিভি দেখা ও গান বাজনা নিষিদ্ধের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন শেখ সাহেবের কথা সবাই মানে। তাই তাকে শ্রদ্ধা করেই এসব কেউ করে না। তিনি জানান, কেউ গান-বাজনা করতে চাইলে এলাকার মানুষ জিহাদ ঘোষনা করে রাস্তায় বের হয়ে আসবে।