আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপন চলছে। তবে আর কয়েক কার্যদিবসের মধেই রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনও শেষ হবে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। এরপরই রায়ের তারিখ নির্ধারণ ও নিম্ন আদালতের রায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রায় দেবেন উচ্চ আদালত। কারণ, এতবড় মামলা,অর্থাৎ এত আসামি আর কোনো মামলায় ছিল না। উচ্চ আদালতে এ মামলার কার্যদিবসের সংখ্যাই এ পর্যন্ত প্রায় এক বছরের সমান। বর্তমানে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের যুক্তি উপস্থাপন চলছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘পিলখানা হত্যাযজ্ঞ মামলার ডেথ রেফান্সের ওপর শুনানি চলছে।’ ৩৫৯তম কার্যদিবসে বৃহস্পতিবার আদালত ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি আগামী ২ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ আরও সময় চেয়ে আবেদন করলে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আরও বলেন, ‘একই সাক্ষ্যে নিম্ন আদালতে কারও ফাঁসি, কারও যাবজ্জীবন ও অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। কিছু আসামি খালাস পেয়েছে। আসামি পক্ষ থেকে কিছু আইনি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুতি নিতে হবে। এছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি রয়েছে। সেজন্যই সময়ের প্রয়োজন।’
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ৫ মিনিট রাজধানীর পিলখানায় বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) দরবার হলে প্রবেশ করেন বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। তার কাছে ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হক প্যারেড হস্তান্তর করেন। তারপর ডিজি ও ডিডিজি মঞ্চে নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করেন।
বিডিআরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম সিদ্দিকুর রহমান কোরআন তেলাওয়াত করেন। কোরান তেলাওয়াতের পর দরবারের সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন মেজর জেনারেল শাকিল। তিনি আগের দিনের প্যারেডের প্রশংসা করেন। এরপর তিনি ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ কার্যক্রম প্রসঙ্গে কথা বলেন।
সে সময় জেনারেল শাকিল জানতে চান, ডাল-ভাতের দৈনিক ভাতা সৈনিকরা ঠিকমত পেয়েছেন কিনা। কিন্তু সৈনিকদের জবাব জোরালো ছিল না। দরবারে সাধারণত সৈনিকদের যে ধরনের তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত ইতিবাচক প্রত্যুত্তর থাকে এ ক্ষেত্রে তা ছিল না। ডিজি ডাল-ভাতের কিছু হিসাব, সৈনিকদের ডিএ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন।
৯টা ২৭ মিনিটের দিকে বিজিবির বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়ে একদল বিদ্রোহী সৈনিক। হঠাৎ রান্নাঘরের পাশ দিয়ে অস্ত্র হাতে প্রবেশ করেন সিপাহী মইন। মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে অস্ত্র তাক করলে পাশের কর্মকর্তারা মইনকে নিরস্ত্র করতেই জাগো স্লোগানের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে বিদ্রোহীরা। শুরু হয় গুলিবর্ষণ।
বিদ্রোহীদের সামাল দিতে বের হলে কর্নেল মুজিব, লে. কর্নেল এনায়েত আর মেজর মকবুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিকে, দরবার হলের ভেতরে অবস্থানরত সেনা কর্মকর্তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। প্রাণ বাঁচাতে এদিক-সেদিক পালিয়ে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে গুলি করা হয়। দুপুরের আগেই হত্যা করা হয় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে।
এ ঘটনায় মোট ৭৪ জন সামরিক-বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়। অমানসিক অত্যাচার চালানো হয় সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রী-সন্তানদের ওপর। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পর মৃতদেহগুলো প্রথমে পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করা হলেও পরে কয়েকটি মৃতদেহ নর্দমার ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয়। দরবার হলের সামনে থেকে দুপুর ১টার দিকে বাকি মৃতদেহগুলো ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
দুটি গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহগুলো মাটি চাপা দেয়া হয়। বিদ্রোহের পর পুরো পিলখানায় চলছিল গুলিবর্ষণ। সকাল থেকেই স্থানীয় সংসদ সদস্য আর জনপ্রতিনিধিরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিলেন। দুপুরের মধ্যে পিলখানার চার পাশে সশস্ত্র অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী।
বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ধ্যায় একটি হোটেলে চলে দফায় দফায় বৈঠক।
এরপর রাত ১টার দিকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি দল পিলখানার ভেতরে প্রবেশ করে। বিডিআরের কিছু সদস্য অস্ত্রসমর্পণ করেন। ভোরের দিকে কয়েকটি পরিবারকে উদ্ধার করেন তারা। অবশ্য, তখনো থেমে থেমে চলছিল গুলিবর্ষণ। পরদিন সকাল থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় পিলখানায় আটকে পড়া মানুষদের।
দুপুরে বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণ করলেও চার পাশে অবস্থানরত সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ে ভেতরে। সঙ্গে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেডসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা নাগাদ পিলখানা থেকে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ।
পরবর্তীতে বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বিডিআর-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা রাখা হয় মৃত্যুদণ্ড। ওই বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে বিশেষ আদালত ১৫২ জনকে ফাঁসি, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়।
এখন উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রম চলছে। বিচার চলছে বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া মামলার।
এত দিনে পিলখানার দরবার হল থেকে মুছে গেছে গুলির চিহ্ন। শোকের কোনো চিহ্নও সেখানে নেই। কিন্তু স্বজনহারাদের হৃদয়ের যে ক্ষত, তা এখনো শুকায়নি। ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এই বিদ্রোহ নিয়ে মানুষের মনে যেসব প্রশ্ন রয়েছে তার পরিষ্কার কোনো জবাব এখনো মেলেনি।