স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সহায়তা প্রদানের জন্য বিসিএস কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমাদের যেসব বিসিএস কর্মকর্তা স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছেন, তারা একটু খেয়াল রাখবেন যাতে আমাদের নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিরা তাদের ক্ষমতা যথাযথ কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন।
পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, মা-বাবা, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী সহ একইদিনে পরিবারের ১৮ সদস্যকে হারিয়েছি। হয়তো পাগলই হয়ে যেতাম। অন্তত মুত্যুর পর যদি প্রিয় বাবার সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে যেন এটুকু বলতে পারি যে, আপনার প্রিয় মানুষদের জন্য এটুকু করে আসতে পেরেছি।’
আগামীর প্রজন্মের জন্ম একটি সুন্দর বাসযোগ্য বাংলাদেশ রেখে যাওয়ায় দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব হারানোর বেদনা বুকে নিয়েও আমার একটাই প্রেরণা, ক্ষমতা আমাকে কিছু দেবে না। আমি ক্ষমতা চাই না, কিন্তু ক্ষমতা একটা সুযোগ জনগণের সেবা করার, মানুষের কল্যাণ করার। আর সেই কল্যাণ করাটাই আমার লক্ষ্য। দিনরাত অবহেলিত মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করছি। এর বাস্তবায়নের অনেকটাই আপনাদের ওপর নির্ভরশীল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) উইমেন নেটওয়ার্ক’র ৫ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক।
বেগম নাসরিন আক্তার স্বাগত বক্তৃতা করেন। মাঠ পর্যায়ের নবীন কর্মকর্তা ফারহানা জাহান উপমা, ঝুঁকিপূর্ণ পেশার প্রতিনিধি হিসেবে বক্তৃতা করেন ফাতেমা বেগম অতিরিক্ত আইজিপি এবং রেক্টর পুলিশ কলেজ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রূপকল্প-২০২১, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ২০৪১ এর একটাই উদ্দেশ্য। আমরা হয়তো তা দেখে যেতে পারব না। কিন্তু দেশের দুঃখী মানুষের মুখে যেন হাসি ফুটে, তারা যেন দু’বেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পায়, সে লক্ষ্যেই দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী ঘরের কাজে নারীদের সহযোগিতায় পুরুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে স্বামী-স্ত্রী দু’জন চাকরি করলে, স্বামী ঘরে এসে বলেন, উফ ভীষণ ক্লান্ত নারীকে দিনভর কাজের পরেও সন্তানের যত্নআত্তি করতে হয়, ঘরের কাজ সামলাতে হয়। সুতরাং নারীরাও ক্লান্ত থাকেন। এই অবস্থায় পুরুষরাও কিন্তু তার স্ত্রীর কাজে সহায়তা করতে পারেন।
তিনি বলেন, নারী-পুরুষ ভাগাভাগি করে নিলে সব কাজই সুন্দর হবে, সংসার সুন্দর হবে।
অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী বেগম সাহারা খাতুন, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, মন্ত্রণালয় এবং সরকারের বিভিন্ন দফতরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, বিদেশী কূটনৈতিক এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এসব শিখেছি আমার ছেলের কাছ থেকে। সে ও তার স্ত্রী দু’জনই অফিসে কাজ করে। বাসায়ও দু’জন কাজ ভাগ করে নেয়।’ কাজেই কাজ পারি না, বললে হবে না, শিখে নিতে হবে। স্ত্রীকে সহায়তা করতে হবে।
ব্যক্তিগত জীবনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমার নাতিরাও আমার কাছে আবদার করে। সেদিন নাতি বললো, আমি ভাত খাবো না, পোলাও খাবো। দাদার পুকুরের মাছ মেরে এনেছে মজা করে রান্না করতে হবে। রান্না মজার হয় কি না, রীতিমত টেনশনে পড়ে গেলাম।’
তিনি বলেন, ‘আমি একজন মা, আমি বুঝি না, আমি রান্না করি শুনে সবাই অবাক হয় কেন? আমার রান্না ছেলে-মেয়েরা পছন্দ করে। তাই আমি রান্না করি। প্রত্যেক মা-ই তাই করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সমাজ পুরুষ শাসিত। তাই পুরুষরা দ্রুত টায়ার্ড হয়ে পড়েন। কাজেই আর টায়ার্ড হবেন না বলে আশা করি। তারাও নারীদের কাজে সহযোগিতা করবেন।
খেলাধুলায় নিজের আগ্রহের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেলাধুলায় নারীদের আগ্রহী করতে আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। বর্তমানে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিসসহ বিভিন্ন খেলায় বাংলাদেশের মেয়েরা অংশ নিচ্ছে এবং তারা বেশ ভালোও করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি তখন হাইকোর্টের বিচারপতি, সংসদে স্পিকার কিংবা কোনো জেলাতেও ডিসি পদে নারী কর্মকর্তা ছিলেন না। আমরা ক্ষমতায় এসে নারীদের উচ্চ পদে নিয়োগ দিতে শুরু করি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদেও নারী আছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভিসি, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বুয়েটেও নারী উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছি। তাদের যোগ্যতা কর্মক্ষেত্রে প্রমাণ করে তারা বেশ প্রশংসাও পাচ্ছেন ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও এগিয়ে নারীরা। এখন দেশের বিরোধী দলের নেতা, স্পিকার, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীদের উচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী নৌবাহিনীতেও নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশে একটা ইউনিক সিচুয়েশন তৈরী হয়েছে। জানি না, আর কোথাও কোনদিন হবে কি না।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা-রওশন এরশাদ এখানে উপস্থিত আছেন, সবাই নারী। সংসদ সদস্য হিসেবেও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ২১ জন এবং সংরক্ষিত আসনে ৫০ জন নারী সদস্য আছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে ভাবা হতো, নারীরা পুরুষের মতো উচ্চ পদের কাজে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে না। যে কারনে ’৯৬ পরবর্তী সময়ে আমি যখন ডিসি-এসপি পদে নারীদের পদায়ন করি তখন ব্যাপক সমালোচনা শুনতে হয়। কিন্তু এসব পদে মেয়েদের নিয়োগের ব্যবস্থা করেছি। তারা প্রমাণ করেছেন, তারাও পারেন।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি নারীদের অগ্রগতি ছাড়া রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব নয়, তাই এসব পদক্ষেপ নিয়েছি।
ইসলামে নারীর মর্যাদা সমুন্নত রাখা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আজ সব ক্ষেত্রে নারীরা তাদের অর্জন নিশ্চিত করছেন। তিনি বলেন, নারীদের এই এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
তিনি নারী উন্নয়নের প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যও সংশ্লিষ্ট মহলকে তাগিদ দেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি ২০১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের অব্যাহত সন্ত্রাস ও আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার তীব্র সমালোচনা করেন।
একইসঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি সকলকে সতর্ক করেন।
তিনি বলেন, আমরা ৬ দশমিক ৫৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশকে আমরা উদ্বৃত্ত খাদ্যের ভা-ারে পরিণত করেছি। দেশের উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর করেছি। সারাদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। ছিটমহল বিনিময়, সমুদ্র সীমা নির্ধারণসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ অবহেলার চোখে দেখে না।
দুর্যোগ মোকাবেলায় সাধারণ মানুষের সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা একদিকে যেমন উন্নয়নের মডেল, আরেকদিকে দুর্যোগ মোকাবেলারও রোল মডেল। আমরা দেশটাকে সুন্দরভাবে গড়তে চাই, যেন আর ক্ষুধার্ত-বুভূক্ষু না থাকে।’
তৃণমূলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু শহরভিত্তিক নয়, উন্নয়ন তৃণমূল পর্যন্ত করতে হবে। তৃণমূল পর্যন্ত ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা না হলে সকল কষ্টই বৃথা যাবে।’
বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে সবাইকে পহেলা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘ফাগুন মাস আসলেই আমাদের মনটা একটু রোমান্টিক হয়ে যায়। হলুদ শাড়ি- লাল পাড়, হাতে ফুল নিয়ে চলে বেড়াচ্ছে। এটাই তো বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।’