সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : একমাস পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাওরটির বেড়িবাঁধ রক্ষায় সব ধরণের চেষ্টা করেছিলেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শনির হাওরপাড়ের অর্ধশতাধিক গ্রামের কৃষক। কিন্তু সবচেষ্টা ব্যর্থ করে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে রবিবার ভোর থেকে ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে হাওরটির ১০ হাজার হেক্টও বোরো জমির আধা পাকা বেরো ধান।
সুনামগঞ্জ জেলার অন্যতম সর্ববৃহৎ শনির হাওরে রবিবার ভোররাতে থেকেই হাওরটির তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের রাজধরপুর গ্রাম সংলগ্ন লালুরগোয়ালা প্রকাশ লালুরখালী বেরীবাঁধটি ৫০ ফুট দ¦ীর্ঘ হয়ে ভেঙ্গে গেলে প্রথমে হাওরের ঢলের পানি ডুকতে শুরু করে। এছাড়াও রামজীবনপুর গ্রামের সামনে বেরীবাঁধের একটি অংশও ভেঙ্গে যায়।
ভেঙ্গে যাওয়া অংশ দিয়ে তীব্র ঢলের পানি হাওরটির পাশ দিয়ে বয়ে চলা বৌলাই নদীরবিপদসীমা অতিক্রম একদিনের তান্ডবে হাওরটির ১০ হাজার হেক্টর জমির এক ফসলী আধা পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেল। হাওরটির ৬ হাজার হেক্টর জমিতে তাহিরপুর উপজেলার কৃষকরা এবং ৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাশর্^বর্তী জামালগঞ্জ ও বিশ^ম্ভরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার কৃষকরা চলতি মৌসুমে বোরো ধান চাষ করেন।
এদিকে বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি ঢুকার খবর শুনে হাওরপাড়ের অর্ধশতাধিক গ্রামের কৃষক পরিবারে চলছে আহাজারি রবিবার দিনভর কারো চুলাও জ¦লেনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস সালাম জানান, শনির হাওরের ৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন তাহিরপুর উপজেলার কৃষকরা। হাওরের বাকী জমির ধান পাশর্^বর্তী জামালগঞ্জ, বিশম্ভরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার কৃষকরা চাষ করেন। তাঁর দাবী তাহিরপুর উপজেলায় এ পর্যন্ত ১৫ হাজার একশত হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে কৃষকরা জানিয়েছেন, পানিতে তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ২ হাজার হেক্টরেরও অধিক হবে।
হাওরপাড়ের বাসিন্দারা জানান, মার্চ মাসের শেষ দিকে টানা বৃষ্টি শুরু হলে নিজের জমির ধান পানি থেকে রক্ষায় কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধে কাজ শুরু করেন। টানা একমাস রাতদিন হাওরের বাঁধে কাজ করেছেন হাওরপাড়ের অর্ধশতাধিক গ্রামের হাজারো কৃষক। কিন্তু টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলে হাওর সংলগ্ন বৌলাই নদীর পানি বেড়ে চলায় শেষ রক্ষা হয়নি। বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে পড়েছে হাওরের বেড়ীবাঁধ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৭, ১৯৯৩ ও ২০১০ সালে তাহিরপুর উপজেলাসহ আশেপাশের সবগুলো হাওরের এক ফসলী বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেলেও ঠিকে ছিল শনির হাওরটি। কিন্তু এ বছর বেরীবাঁধের কাজ নিম্নমানের হওয়ার মার্চের শেষ দিকে নদীতে সামান্য পানি বৃদ্ধি পেলেই ঝুঁিকপূর্ণ হয়ে ওঠে বিভিন্ন বাঁধ। কৃষকরা এ ঝুঁকিপূর্ণ বেরীবাঁধ রক্ষায় গত একমাস কাজ করেন ।
হাওরটির মধ্য তাহিরপুর গ্রামের কৃষক একরাম হোসেন বলেন, ভাই ধার দেনা করে হাওরটিতে ১৫ কিয়ার জমি করেছিলাম, সব ধানই কাঁচা, যা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পানিতে তলিয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, পরিবারের সবাইকে নিয়ে সারা বছর কি খেয়ে বাঁচব সে চিন্তাই করছি রবিবার ঘরে রান্নাও হয়নি।
হাওরপাড়ের ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলো হচ্ছে ভাটি তাহিরপুর, ঠাকুরহাটি, গোবিন্দশ্রী, জাকিরনগর, সাহাগঞ্জ, শ্রীপুর, নিশ্চিন্তপুর, ইকরামপুর, নোয়ানগর, মাড়াল, গোপালপুর,সাহেবনগর, রামজীবনপুর, আলীপুর, রাধানগর, বেহেলী, ইসলামপুর, চন্ডীপুর, শিবপুর, মশালঘাট, রাজিনপুর, বসন্তপুর, বাগোয়া, শাহাপুর, দাওয়া, মাহমুদপুর, বারুংকা, তিওরজালাল, পাতারি, আনোয়ারপুর, লোহাচুড়া, নোয়াহাট, ফাজিলপুর, দক্ষিণকুল, হোসেনপুর, চিকসা, বীরনগর, জয়নগর, ধুতমা, উজান তাহিরপুর, মধ্য তাহিরপুর। এছাড়াও পাশর্র্বতী কিছু গ্রামের কৃষকরা এ বৃহত্তর হাওরটিতে বোরো ধান চাষ করে থাকেন।
জানা যায়, বিশাল এ হাওরটি বছরের ৬ মাস কয়েক ফুট গভীর পানিতে নিমজ্জিত থাকে। পৌষ মাসে হাওরটিতে বোরো ধানের চারা রোপন করা হয়। যা বৈশাখ মাসে কাটা হয়। আর এক ফসলী এই বোরো ধানই হাওরপাড়ের ৯৫ ভাগ পরিবারের আয়ের প্রধান অবলম্বন। একমাত্র ফসল হারিয়ে হাওরপাড়ের এই সকল গ্রামের পরিবারগুলো এখন দিশেহারা।
পিআইসি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকের কয়েক কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে ঘাঁ ঢাকা দেয়ার পর টানা এক মাসের অধিক সময় ধরে হাওর পাড়ের ৫০ গ্রামের কয়েক হাজার কৃষককে নিয়ে রাতদিন বাঁধ হাওর বেরীবাঁধ রক্ষায় মাটি ভরাটের কাজ করে গেছেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান ।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম রবিবার রাতে বলেন-পাউবো, ঠিকাদার ও পিআইসিন অনুপস্থিতে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের একাধিক বেরীবাঁধে স্থানীয় লোকজন ফসল রক্ষার জন্য টানা একমাস ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছেন, কিন্তু বিধিবাম, সব চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়ে রবিবার ভোরে থেকে লারুর খালি বাঁধ দিয়ে পানি ডুকে যায়, এরপরও লোকজন সারাদিন চেষ্টা করেছেন বাঁধ ঠিকবয়ে রাখতে কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো হাওর জুড়ে বানের পানি সাগরের রুপ করেছে।
তিনি আরো জানান, কৃষক পরিবারগুলো যাতে করে ভাতের জন্য কষ্ট না করে সেজন্য প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক পরিবার প্রতি ২০ কেজি চাল উপজেলার সাড়ে বার হাজার কৃষক পরিবারকে সোমবার থেকে দেয়া হবে।