অগ্রসর রিপোর্ট : ‘আপনাকে যদি একজন কৃষকের ছবি আঁকতে বলা হয় তাহলে কী আঁকবেন? এই কিছুদিন আগেও নিশ্চয়ই একজন লুঙ্গি পরা, খালি গা, মাথাল মাথায়, কাস্তে হাতে হাড্ডিসার একজন মানুষের ছবি আঁকা হতো। তবে এখন চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। আবার যদি একটি মাঠের ছবি আঁকতে বলা হয়? তাহলে শালিক উড়ে যাচ্ছে এমন একটি ধান বা গম ক্ষেতের ছবি আঁকবেন। কিন্তু দিন বদলে যাচ্ছে। আগামী দিনের ছবিও বদলে যাবে।’ কথাগুলি বলছিলেন চুয়াডাঙ্গা সদরের উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ তালহা জুবাইর মাশরুর।
তালহা আরও বলছিলেন, আগের দিনে আমাদের কৃষি ছিল কোনো রকমে বেঁচে থাকার কৃষি। নিজের যা জমি আছে, তাতে অথবা কিছু জমি বর্গা নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করে কোন মতে ডাল-ভাত খেতে পারলেই কৃষক সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু এখন আমরা অগ্রসর হচ্ছি বাণিজ্যিক কৃষির দিকে। একজন মানুষ যাতে কৃষিখাতে এসে সফল ব্যবসায়ী হতে পারেন, সে জন্য বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। কৃষির মাধ্যমে যাতে সমৃদ্ধি আসে সে জন্য নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অনেকগুলি শাখা নিয়ে কৃষির সম্প্রসারণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে ‘টেকসই, নিরাপদ ও লাভজনক কৃষির’ লক্ষ্য নিয়ে ৮টি উইং এর সমন্বয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
কৃষকদের এগিয়ে নিতে দেশে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে মধ্যে কৃষকদের মাঝে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষকদের মাঝে কৃষি কার্ডের মাধ্যমে উন্নত সার-বীজ বিতরণ নিশ্চিত করা, উন্নত জৈব সার, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, কৃষক পর্যায়ে মানসম্মত বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ নিশ্চিত করা। এছাড়া সবচেয়ে বেশি কাজ হচ্ছে, যে ফল বা ফসলগুলি সাধারণত আমদানি করা হয়ে থাকে সেগুলি নিয়ে। এ লক্ষ্যে দেশে আমদানি নির্ভর ফল বা ফসলের মানসম্মত চারা উৎপাদন ও বিতরণ, বাণিজ্যিক চাষের জন্য বিভিন্ন ফল/ফসলের জাত উন্নয়ন ও বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে শিক্ষিত ও তরুণরা যাতে কৃষিতে আগ্রহী হয় এবং দক্ষতার সঙ্গে কৃষি উদ্যোক্তা হতে পারে সে জন্য তাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, জাত উন্নয়ন, নতুন জাত উদ্ভাবন বা নতুন জাতের সঙ্গে আমাদের কৃষকদের পরিচিত করানোর জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রখ্যাত কৃষিবিদ ড. এম. এ. রহিমের নেতৃত্বে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ গাছের জাতের সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে যেসকল গাছের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোর চারা উৎপাদনও করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, শুধু আপেল, কমলা ও আঙুর আমদানিতেই বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এছাড়া অন্য ফল মিলে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা যাতে বিদেশে চলে না যায় সে জন্য কাজ করছে কৃষি সমম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কৃষিকে আমদানি থেকে রফতানিমুখী করতে কৃষকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষি অধিদপ্তরের অনেকগুলি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে কোনোটি কেন্দ্রীয়ভাবে আবার কোনটি স্থানীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
এমনই একটি ডিজিটাল কৃষি সম্প্রসারণ উদ্যোগ কৃষি বায়োস্কোপের অধীনে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের ধারাবাহিকভাবে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালা চলছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৪০ জন করে ২টি ব্যাচের কর্মশালা শেষ হয়েছে। এতে সারাদেশ থেকে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করছেন। ধারাবাহিকভাবে এটি চলমান থাকবে।
কর্মশালায় অতিথি হিসেবে অংশ নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ ড. মেহেদি মাসুদ বলেন, ‘আমার যদি ৪০/৫০ বিঘা জমি থাকত তাহলে আমি সেখানে থাই কাটিমনসহ কয়েক জাতের আম গাছ লাগাতাম। এরপরে সেগুলোর যথাযথ পরিচর্যা করে বাকি জীবন বসে বসে খেতাম। আমাদের দেশের তরুণরা যদি এই খাতে এগিয়ে আসে, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে যদি নিজের ফল বাগান গড়ে তুলে তাহলে তাকে আর চাকরির পিছনে ছুটতে হবে না। বরং তার অধীনে অনেকগুলি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’
এ প্রসঙ্গে কৃষি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো: আবদুল মুঈদ বলেন, ‘কৃষিতে সারাদেশে একটি বিপ্লব ঘটেছে। এখন সারা বছরই বাজারে আমাদের দেশি ফল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের মানুষ ফল খেতে পাচ্ছে আবার বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে তারা উদ্যোগ সম্প্রসারণের জন্য ঋণ পায় না। কৃষি উন্নয়ন ব্যংকের মাধ্যমে আমরা সেই সমস্যার সমাধান করছি। যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হতে যাচ্ছেন তারা খুবই সহজে এবং সহজ শর্তে ঋণ পাবেন।’
উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর আগেই খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার ‘দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৫’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) পূরণের ক্ষেত্রে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে সফল দেশ। বর্তমানে বিদেশে চালসহ বেশ কিছু খাদ্যপণ্য রফতানিও করা হচ্ছে।