২০০২ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত— ১৫ বছরে ১৭৮টি হত্যা ও হামলার দায় স্বীকার করে চিঠি দিয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। একই সঙ্গে সংগঠনটি হামলা ও হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে একটি তালিকাও দিয়েছে। এরমধ্যে ১৮টি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। যার অধিকাংশই তদন্তাধীন রয়েছে। তাদের দাবি, তারা এই ১৭৮টি হত্যাকাণ্ড ও হামলার বাইরে আর কোনও হামলার সঙ্গে তারা জড়িত ছিল না। তবে যারাই হামলাগুলো করে থাকুক, তাদের প্রশংসাও করেছে তারা। রবিবার দুপুরের পর ডাকযোগে বাংলা ট্রিবিউন কার্যালয়ে এসব হত্যাকাণ্ড ও হামলার দায় স্বীকার করে তিনটি কাগজে মোড়ানো একটি মেমোরিকার্ড পাঠায় জেএমবি। এদিকে, আইনশৃঙ্খলার ক্ষাকারীবাহিনী তাদের নব্য জেএমবি দাবি করছে। তারা যে হামলা ও হত্যাকাণ্ডগুলোর দায় স্বীকার করেছে, সে বিষয়ে অবহিত আছে বলেও জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
মেমোরিকার্ডে দুটি ফোল্ডারের একটিতে তারা জানায়, গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় ঢালাওভাবে তাদের জড়িত থাকার কথা বলা হচ্ছে। তারা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। দ্বিতীয় ফোল্ডারে তারা যে হামলাগুলোর দায় স্বীকার করে, তার তালিকা দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের আহ্বান জানানো হয়।
চিঠিতে হত্যাকাণ্ড ও হামলার তালিকা দেওয়া হয়েছে। জেএমবি যে সব হত্যাকাণ্ড ও হামলা চালানোর দায়স্বীকার করেছে, সেগুলো হলো:
২০০০-২০০৫ সালে শতাধিক এনজিওর ওপর আক্রমণ।
২০০৩-২০০৫ সালে ৫০-এর অধিক যাত্রা প্যান্ডেলে হামলা।
২০০২ সালে ৫টি সিনেমা হল ও সার্কাসে হামলা, দুই পুলিশের ওপর হামলায় নিহত ২।
২০০৩ সালে জয়পুরহাটে ৫ জন খাদেমের শিরশ্ছেদ।
২০০৩ সালে টাঙ্গাইলের তকতায় বোমা ও গ্রেনেড হামলা।
২০০৪ সালে ড. হুমায়ুন আজাদ ও ড. ইউনুস হত্যাকাণ্ড।
২০০৪ সালে টাঙ্গাইলে হোমিও ডাক্তার মনিরুজ্জামান হত্যা।
২০০৪ সালে বাগমারা, নওগা, আত্রাইয়ে ‘সর্বহারা’ উৎখাত।
২০০৪ সালে জামালপুরে খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের নেতা গণী গোমেজ হত্যা।
২০০৫ সালে জামালপুরের হৃদয় রায় হত্যা।
২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসটিতে সাউন্ড ব্লাস্ট।
২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ সাউন্ড ব্লাস্ট।
২০০৫ সালের অক্টোবরে লক্ষ্মীপুর আদালতে হামলা।
২০০৫ সালে ঝালকাঠিতে ২ বিচারক হত্যা।
২০০৫ নেত্রকোনার উদীচী অফিসে হামলা।
২০০৫ সালে গাজীপুর আদালতে হত্যা।
২০০৬ সালের অক্টোর থেকে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি চারটি টহল গাড়িতে গ্রেনেড হামলা।
২০০৭ রাষ্ট্রপক্ষের পিপি হায়দার হত্যা।
২০০৯ টহল গাড়িতে গ্রেনেড হামলা।
২০১৩ সালে লুৎফর রহমান ফারুকি হত্যা।
২০১৪ সালে প্রিজনভ্যানে হামরা চালিয়ে কর্মী মুক্ত।
২০১৬ সালে রাজশাহীর তানোর থানায় শহিদুল্লাহ হত্যা।
বাংলা ট্রিবিউন কার্যালয়ে পাঠানো মেমোরিকার্ডটি যে তিনটি গলুদ কাগজে মোড়ানো ছিল, তার একটিতে লেখা জামা’আতুল মুজাহিদীনের পক্ষ থেকে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতি, অত্র খামে রক্ষিত মেমোরি কার্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে।
পাঠানো নথিতে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলার দায় অস্বীকার করে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। তারা গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় কোনোভাবে জড়িত নয় দাবি করলেও এ পর্যন্ত জড়িত যেসব হামলার তালিকা দিয়েছে আরেকটি পিডিএফ ফাইলে, সেটার শুরুতে যে ছবি দিয়েছে, তার একদিকে আইএস-এর পতাকা, আরেকদিকে তাদের সংগঠনের লোগো রয়েছে।
ডাকে আসা খামে প্রেরক হিসেবে ময়নুল ইসলাম, পিতা মোফাজ্জল হোসেন, গাজীপুর লেখা। মেমোরিকার্ডে যে তথ্য ছিল, সেখানে নিজেদের জেএমবি দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ইউনুস হত্যার দায় তারা স্বীকার করেছে। এছাড়া, ২০০২ সালে চারটি সিনেমা হল, সাতক্ষীরায় পুলিশ হত্যা ও যাত্রা প্যান্ডেলে বোমা হামলার কথা স্বীকার করা হয়েছে। তারা ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শতাধিক হামলা করেছে বলে দাবি করে। ২০০৪ সালে টাঙ্গাইলে হোমিও ডাক্তার মনিরুজ্জামানকেও তারা হত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। আব্দুল আউয়াল ব্রিগেড, হাফেজ মাহমুদ ব্রিগেড, আতাউর রহমান সানি ব্রিগেডসহ নানা নামে এগুলো সংঘটিত করা হয়েছে দাবি করে সেই কাগজে দাবি করা হয়, ২০০৭ সালে শাইখ আব্দুর রহমানের ফাঁসি কার্যকরের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হায়দারকে তারা হত্যা করেছে।
এছাড়া দুই বিচারকসহ অসংখ্য হত্যার দায় স্বীকার করে গত তিন বছরের হিসাব দিয়ে সংগঠনটি বলছে, ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট নুরুল ইসলাম ফারুকী ও ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে তারাই হত্যা করেছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে তানোর থানায় শহীদুল্লাহকে হত্যা করে তারা। সবকয়টা হত্যাকাণ্ডকে তারা শাস্তিমূলক হত্যা দাবি করে।
এর বাইরে কোনও হত্যাকাণ্ডের দায় তারা নেবে না দাবি করে বলছে, অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জানাতে চাই যে, উল্লিখিত সব হামলার দায় জামায়াতুল মুজাহিদীন স্বীকার করছে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে যে চারটি হামলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার বাইরে যে সমস্ত হামলায় তাদের জড়ানো হচ্ছে, এর সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। তারা বলছে, একটি ফোল্ডারে সংরক্ষিত পিডিএফ ফাইলে লেখা, আমরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিচ্ছি, এ হামলা আমরা চালাইনি এবং এতে আমাদের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে, যারা অপারেশন যারা চালিয়েছে, তাদের প্রসংশাও করেছে জেএমবি। তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রুসেডাররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চালাচ্ছে, তারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে। এদিকে, আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জেএমবি জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে।
এই ডিজিটাল নথি পাঠানো বিষয়ে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এরা নব্য জেএমবি। এদের কার্যক্রমের অনেক তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে আছে। এছাড়া তাদের বর্তমান বক্তব্যগুলোও যাচাই করে দেখা হবে।