কম্পিউটার সংবাদ- কম্পিউটার সামগ্রীর পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ইনডেস্ক আইটি। সম্প্রতি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে এ প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পাওনার পরিমাণ ১৫ কোটি টাকার বেশি। মূলত মোটা অঙ্কের এ বকেয়া আদায় করতে না পেরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে বলে জানান ইনডেস্ক আইটির প্রধান নির্বাহী আজিজ রহমান।শুধু ইনডেস্ক আইটি নয়, ব্যবসা বন্ধ করেছে এ খাতের ৩২টি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান। অনেকে ব্যাংকঋণের চাপে ছেড়েছেন দেশ। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ৫ হাজার কোটি টাকার এ বাজার ক্রমে বড় হচ্ছে। দিন দিন এ সামগ্রীর ব্যবহার বাড়লেও শুধু অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তরুণ উদ্যোক্তারা।
জানা যায়, বছর দুয়েক আগে ব্যবসা বন্ধ করেছে পরিবেশক প্রতিষ্ঠান এডেক্সেল। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ২ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া গত দুই বছরে কমভ্যালি, খান জাহান আলী কম্পিউটারস, ডেস্কটপ কম্পিউটারের মতো পরিবেশক প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার সামগ্রীর ব্যবসা থেকে সরে এসেছে। আইডিবি ভবনের অন্যতম পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ডলফিন কম্পিউটার বিক্রি হয়ে গেছে ড্যাফোডিল কম্পিউটারের কাছে। আজিজ রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এ ব্যবসার জন্য এখনো কোনো পলিসি নির্দিষ্ট করতে পারেনি সরকার। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও নেই নৈতিকতা। বছরের পর বছর বাকিতে ব্যবসা করে অর্থ ক্যাশ করছেন তারা। এভাবে কোনো ব্যবসাই দাঁড়াতে পারে না। ভবিষ্যতে আবারো কম্পিউটার সামগ্রীর ব্যবসা শুরুর আগ্রহ নেই বলেও জানান তিনি।একই ধরনের বক্তব্য খান জাহান আলী কম্পিউটারসের স্বত্বাধিকারী মো. মুসতাকের। তিনি বলেন, ‘একসময় আমরা কম্পিউটার সামগ্রী আমদানি করতাম। সরাসরি বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আমাদের ব্যবসা ছিল। কিন্তু এক বছর ধরে এসব করছি না। যদিও সীমিত আকারে কিছু পণ্য বিক্রি করছি, কিন্তু তা উল্লেখ করার মতো না। ভবিষ্যতে ব্যাপক আকারে এ ব্যবসা শুরুর সম্ভাবনাও নেই।’ খাতটির ভেতরকার অসুস্থ প্রতিযোগিতাই এর জন্য দায়ী বলে জানান তিনি।
খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায় ১০ কোটি টাকা রয়েছে দেশের বৃহত্তম পরিবেশক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ব্র্যান্ডের। ব্যবসার এ অবস্থায় টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুল ফাত্তাহ।এ বিষয়ে তিনি বলেন, কম্পিউটারের বাজারটা চলছে বাকিতে ব্যবসার ওপর। অনেক প্রতিষ্ঠান এর ফলে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরো অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন। এ ব্যবসা করে টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এর পাশাপাশি অন্য কোনো খাতে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করছেন তিনি।তিনি আরো বলেন, সরকারেরও এ খাতে বিশেষ কোনো নজর নেই। পাশাপাশি এসব পণ্যের মূল্যহার নির্ধারণেও সরকারি বা বেসরকারি পক্ষ থেকে কেউ উদ্যোগী হয়নি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও কম্পিউটার সামগ্রীর ব্যবসায়ীদের জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই। এছাড়া শুধু কম্পিউটারের কাস্টম ডিউটি ৮ শতাংশের মধ্যে থাকলেও এ-সংক্রান্ত অন্যান্য প্রডাক্টে এ হার ৩৭ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে অন্যতম প্রধান বাধা।অনুসন্ধানে জানা যায়, কম্পিউটার সামগ্রীর দামের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত কোনো সীমারেখা নেই। একই পণ্য বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ী বিক্রি করছেন ভিন্ন ভিন্ন দামে। এক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নেই দেশের কম্পিউটার ও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ আমদানিকারক, পরিবেশক, বাজারজাতকারী, খুচরা বিক্রেতাদের সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের প্রডাক্ট ম্যানেজার বদিউজ্জামান অপু বলেন ‘পরিবেশক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ আমাদের পরিকল্পনাগুলো করা হয় তাদের নিয়েই। তাই এক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়। বিনিয়োগ পরিকল্পনাটাও নতুন করে সাজাতে হয়। দেশের পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ অবস্থার জন্য বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এছাড়া ক্রেতারাও প্রডাক্ট কেনার সময় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ছেন।’ জানা গেছে, নির্ধারিত মূল্যহার না থাকায় কম দামে বেশি বিক্রির অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে বিভিন্ন পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের অপেশাদার আচরণে এ খাত থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের বেশকিছু পরিবেশক প্রতিষ্ঠান খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে যে দামে প্রডাক্ট বিক্রি করছেন, একই দামে সরাসরি বিক্রি করছেন ব্যবহারকারীদের কাছেও, যা এ ব্যবসার সম্প্রসারণে একটি বাধা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে ক্যাসপারস্কির পরিবেশক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে অফিস এক্সট্র্যাকটস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী প্রবীর সরকার বলেন, ‘আমরা বরাবরই আমাদের পলিসি ঠিক রেখেছি। সে অনুযায়ীই আমরা আমাদের পণ্য বিপণন করি। আমাদের মূল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিপত্র অনুযায়ী আমরা খুচরা ব্যবসায়ী ছাড়া সরাসরি গ্রাহকদের কাছে প্রডাক্ট বিক্রি করতে পারি না। আমাদের প্রতিষ্ঠানে বাকিতে ব্যবসা করার সুযোগ নেই।’ তিনি আরো বলেন, এ খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঐক্য নেই। বাকিতে ব্যবসার মাধ্যমে পণ্যের বিক্রি বাড়িয়ে কোনোভাবেই টিকে থাকা যায় না। কারণ দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এতে করে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। প্রডাক্টের নির্ধারিত মূল্য না থাকা এ ব্যবসার একটি বড় সমস্যা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতিরও কোনো উদ্যোগ নেই। প্রডাক্টের মূল্য কখনই সরকার নির্ধারণ করে দেয় না। এ কাজ করতে হয় ব্যবসায়ীদেরই।এ বিষয়ে কম্পিউটার সমিতির মহাসচিব নজরুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে অস্থিরতা চলছে। বিষয়টি আমাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি প্রডাক্টের মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা আমরা তৈরি করেছি। তবে কীভাবে এর প্রয়োগ হবে, সে বিষয়ে কাজ চলছে।’
এদিকে গত তিন বছরে রাজধানীর মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ১০০টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশকিছু প্রতিষ্ঠান কোনো রকমে টিকে আছে। কয়েকটি অচিরেই বন্ধের পর্যায়ে রয়েছে। আবার অনেকে তাদের ব্যবসার পরিসর ছোট করে এনেছেন। রাজধানীর আল্পনা প্লাজা, সুবাস্তু টাওয়ার ও আইডিবি ভবনের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও একই অবস্থা।