সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জে হাওরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫ কর্মকর্তাসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এদিকে, প্রধান আসামিসহ দুইজনকে গ্রেফতার করার খবর পাওয়া গেছে।
রোববার দুপুরে দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে সুনামগঞ্জ সদর থানায় মামলাটি দায়ের করেন। সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার বরকতুল্লাহ খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সুনামগঞ্জ সদর থানার এক কর্মকর্তা জানান, মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরখাস্তকৃত সুনামগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা আফসার উদ্দিনকে।
এ ছাড়া বরখাস্তকৃত সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলামসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন আসামির তালিকায়। বাকি ৪৬জন আসামির মধ্যে রয়েছেন ঠিকাদার, প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইসি) কর্মকর্তারা।
এদিকে আসামিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে কারণে পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকাও এই মুহূর্তে প্রকাশ করছে না পুলিশ।
সুনামগঞ্জে হাওর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় সুনামগঞ্জে নির্বাহী কর্মকর্তা আফসার উদ্দিনকে গত ১৫এপ্রিল প্রত্যাহার করা হয়।
তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে স্থানীয় ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ২৮টি বাঁধ নির্মাণে ২৫কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া সিলেটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের সূত্র ধরেই তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দুদক।
সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী, দু’জন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, আটজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী এবং ৬ জন বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করেই ঠিকাদাররা কোথাও ১৫ শতাংশ, কোথাও ২০ শতাংশ আবার কোথাও কাজ না করেই বিভিন্ন প্রকল্পের বিল বাবদ কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায় বলে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়া যায়।
সুনামগঞ্জে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গত ১৩ এপ্রিল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। গঠন করা হয় তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি।
দুদক পরিচালক বেলাল হোসেনকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন উপ-পরিচালক মো. আবদুর রহিম ও সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি।
দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত সেলের ১২৫৩৯(৩) নম্বর স্মারকে গঠিত ওই কমিটির কাজ তদারকি করছেন দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) মো. আসাদুজ্জামান।
এই কমিটি গত ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৫ দিন সুনামগঞ্জ হাওর বাঁধ নির্মাণ এলাকা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় দফতরে অনুসন্ধান চালায়।
এ সময় তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ২৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এ ছাড়া নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদার, এলাকার সাধারণ মানুষ, ভুক্তভোগী কৃষক, প্রকল্প কমিটির সদস্যসহ আরও শতাধিক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেই সঙ্গে সংগ্রহ করা হয় ঠিকাদারি কাজের যাবতীয় নথি।
এরপরই দুদক নিশ্চিত হয়, বাঁধ নির্মাণে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে এবং দুর্নীতির সঙ্গে কমপক্ষে ২০ জন সরকারি কর্মকর্তা জড়িত।
এছাড়া ১৬০জন ঠিকাদারের মধ্যে কতজন ঘুষ দিয়ে আগাম বিল তুলে নিয়েছেন, কতজন সামান্য কাজ করে পুরো বিল তুলেছেন, তাদের একটি তালিকা তৈরির কাজও করে দুদক।
ঠিকাদারদের সবার নাম, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নথি ও আনুষাঙ্গিক তথ্যও দুদক সংগ্রহ করে।
দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম সরকার ও সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিনের দুর্নীতির কারণেই ঠিকাদাররা কাজ বাস্তবায়নে অমনোযোগী ছিলেন।
তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সুনামগঞ্জে হাওর বাঁধের মোট প্রকল্প ১৬০টি। আর প্রতিটির জন্য একজন করে ঠিকাদার রয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন ও দেখভালের জন্য কমিটি রয়েছে ২৩৯টি। প্রতিটি কমিটিতে সদস্য সংখ্যা ৫ জন করে। এরমধ্যে তিনজন স্থানীয় সদস্যের প্রতিনিধি, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিনিধি ও একজন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি।
তিনি আরও বলেন, মাটি কাটা প্রকল্প হচ্ছে ২৯৯টি। এসব প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে কর্মকর্তা-ঠিকাদার মিলেমিশে দুর্নীতি আর অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।
দুর্নীতির সব তথ্য-প্রমাণ নিয়ে পর্যালোচনা শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয় বলে জানান তদন্ত কমিটির ওই কর্মকর্তা।