দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব এবং তৃতীয় গভীরতম সমুদ্রবন্দর হতে চলেছে পায়রা। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীর উপকণ্ঠে রাবনাবাদ চ্যানেল বরাবর নির্মিত হচ্ছে এ সমুদ্রবন্দরটি। দেশের অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনা হতে যাচ্ছে এ বন্দর। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের চেয়ে আধুনিক এবং প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বন্দরটির প্রথম টার্মিনাল আগামী ছয় মাসের মধ্যে চালু হবে।
বন্দরটি চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে উন্মোচিত হবে নতুন দিগন্ত। একে ঘিরে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে ওঠবে শিল্প ও কলকারখানা। বন্দর ঘিরে শুধু দেশি নয়, বিদেশি বিনিয়োগেরও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সরকারের পক্ষ থেকে নেপাল ও ভারতসহ বাইরের কয়েকটি দেশকে এ বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এ অঞ্চলে শুরু হয়েছে বিনিয়োগ। এ বন্দর দিয়ে গাড়ি, খাদ্যপণ্য, সার ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি
সরেজমিন বন্দর ঘুরে দেখা গেছে, আন্ধারমানিক নদীর তীরে অর্ধেক ভাসা, অর্ধেক ডুবে থাকা বিস্তীর্ণ লবণের মাঠটি এখন আর চেনার উপায় নেই। তার বুক চিরে হয়েছে চার লেনের চক চকে সড়ক আর বড় বড় নানা স্থাপনা। এ ভাবেই পায়রা সমুদ্রবন্দর বদলে দিচ্ছে পিছিয়ে থাকা উপকূলীয় দক্ষিণ জনপদকে। বন্দরের প্রথম জেটি তৈরির কাজটিও এখন প্রায় শেষের পথে। প্রথম টার্মিনাল, ওয়্যার হাউজ পন্টুন তৈরিও শেষ হয়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ঝড় বৃষ্টি খরতাপ উপেক্ষা করে নির্মাণযজ্ঞ চালাচ্ছেন দেশি-বিদেশি কর্মীরা।
জানতে চাইলে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, এ বন্দর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি সম্ভাবনাময় বন্দর। প্রধানমন্ত্রী এ বন্দরকে নিজে বলেন, এটা আমার বন্দর। পায়রা নামটা তারই দেওয়া। বন্দরের চ্যালেঞ্জ হিসেবে তিনি বলেন, অনেক স্টেকহোল্ডার এখনো বন্দরের ক্যাপাসিটি সম্পর্কে সচেতন নয়।
পায়রা বন্দরের এসব অবকাঠামো তৈরি উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের জন্য খরচ হচ্ছে ১৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। তবে বন্দর পুরোদমে চালু হলে যা কয়েক বছরের আয় থেকেই এ ব্যয় ওঠে আসবে বলে জানান কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম এবং মোংলার পর দক্ষিণাঞ্চলের এই পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে বাংলাদেশের আশা অনেক। বলা হচ্ছে, এ বছরের মধ্যেই বন্দরটি চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা পালটে যেতে পারে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটি হতে পারে একটি মাইলফলক।
বন্দর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উন্নয়নের মহাসড়কে যোগ হতে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় এ বন্দর। ফলে সুনীল অর্থনীতির এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে।
বর্তমানে কনটেইনার টার্মিনাল, বাল্ক টার্মিনাল, মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, মডার্ন সিটি, বিমানবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ১৯টি কম্পোনেন্টের কাজ চলমান রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের মধ্যে পায়রাকে বিশ্বমানের একটি আধুনিক বন্দর এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ একে এক বৃহত্তর আর্থিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বন্দরে অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্যও রয়েছে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান। ফলে কনটেইনার, বাল্ক, কার্গো, এলএনজি, পেট্রোলিয়াম ও যাত্রী টার্মিনাল নির্মাণ, তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সার কারখানা, তেল শোধনাগার, ওষুধ, সিমেন্ট ও জাহাজনির্মাণ শিল্পসহ বিবিধ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বর্তমানে চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ সার দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ৭০ শতাংশ সার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ হলে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে সার কারখানা চালু করা সম্ভব হবে। ফলে দেশের সারের চাহিদা যেমন পূরণ হবে, তেমনি এতদঞ্চলে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।
পায়রা বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ভবিষ্যৎ ৫০ বছরের পরিকল্পনা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরটি তৈরি করা হচ্ছে। যাতে সহজে জাহাজ হেন্ডেল করা যায়।
পদ্মা সেতুকে কানেক্ট করে বরিশাল থেকে পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ফলে পায়রা বন্দরের সঙ্গে সুগম হবে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ। অতঃপর রেলপথের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে যুক্ত থাকবে পায়রা বন্দর। ফলে পায়রা বন্দর হয়ে উঠবে অর্থনৈতিক উন্নতির স্বাবলম্বী এক প্রাণকেন্দ্র। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও উন্নয়ন) কমোডর রাজীব ত্রিপুরা ইত্তেফাককে বলেন, বাংলাদেশের সর্ববৃহত ড্রেজিং প্রকল্প ক্যাপিটাল এবং মেইনটেইন্যান্স ড্রেজিং সম্পূর্ণ করা করা হয়েছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে ১০ মিটার গভীরতা চ্যানেল সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে বন্দরে ৪০ হাজার মেট্রিকটন কার্গো বহনকারী জাহাজ ভিড়তে পারবে।