বদিউর রহমান:
সরকারি চাকরিতে পদ-পদবির বাহার অনেক সময়ে শুধু সংশ্লিষ্ট পদধারীকেই তৃপ্তি দেয় না, বরং তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকেও বেশ সান্ত্বনা দিয়ে থাকে। নিজে সরকারি চাকুরে হয়ে এক্ষেত্রে পদ-পদবির জাদুকরি স্পর্শ যেমন অনুভব করেছি, তেমনি যথাসময়ে সহকর্মীদের সঙ্গে উচ্চপদে যেতে না পেরে যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের খোরাক হয়েছিলাম, তা-ও বেশ টের পেয়েছি। সুপিরিয়র পদ পরীক্ষা (১৯৭৬) দিতে গিয়ে টের পেলাম, ১৩০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা-আবশ্যিক বিষয়ে ৭০০, ঐচ্ছিক বিষয়ে ৬০০-পরে মৌখিক ২০০, মনস্তাত্ত্বিক ১০০-মোট ১৬০০-এ উত্তীর্ণ হয়ে তবে তো পদশূন্যতায় চাকরি পাওয়া। বিজ্ঞাপিত পদও কম, সব ক্যাডার মিলে ১৩৮ বা ১৩৯। তারপর আবার বড় যন্ত্রণা হলো-ইংরেজিতে একটা রচনাই ৩ ঘণ্টা, পূর্ণমান ১০০; বাংলাতেও একটা রচনা ৩ ঘণ্টা, পূর্ণমান ১০০। বাংলায় না হয় গরুর রচনায় গরুকে নদীতে নিয়ে সেখানে নদীর রচনা লিখে পরে নদীকে সাগরে নিয়ে সাগরের রচনা লিখে গরুর রচনায় ৩ ঘণ্টা কাটানো গেল; কিন্তু ইংরেজিতে, কী মহাবিপদ! এ দুটি রচনা লিখতে গিয়েই শত শত প্রার্থী ঝরে পড়লেন।
জিয়া কর্তৃক অধ্যাপক শামস-উল হকের নেতৃত্বে সিলেবাস করে ১৬০০ নম্বরের এ পরীক্ষা দিয়ে দেশে নিয়মিত পূর্ণাঙ্গ সিভিল সার্ভিসে এন্ট্রি পরীক্ষা শুরু হলো। দুটি পরীক্ষায় পাশ মার্ক ছিল ৫০ শতাংশ, পরের পরীক্ষাটিতে পাশ মার্ক ৪৫ শতাংশ হয়ে গেল, কারণ ৫০ শতাংশ পাশ মার্কে বিজ্ঞাপিত পদের সমপরিমাণ থেকে তেমন বেশি লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না। এরপর আবার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের পর পিএসসি’র ৩০০ এবং তখনকার কোটার (COTA) ৩০০ নম্বরের পরীক্ষার পর সর্বমোট ২২০০ নম্বরের ভিত্তিতে চূড়ান্ত জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ।
১৯৮৪ সালের পরীক্ষা থেকে শুরু করে সরকার কেন যে পিছু হটে ১০০০ নম্বরের পরীক্ষায় এলো এবং বাংলা ও ইংরেজির ৩ ঘণ্টা করে একটা রচনা লেখা বাদ দিয়ে দিল, তা আজও বুঝতে পারলাম না। শোনা যায়, পাকিস্তান আমলের কিছু তিন-অক্ষরি সাহেব তাদের ‘অদ্বিতীয়তা’ বহাল রাখার জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কঠোর বাছাই প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে দেয়। অথচ সশস্ত্র বাহিনীতে কমিশন পদে নিয়োগের মান কিন্তু এখনো ধরে রাখা হয়েছে। ফলে সিভিল সার্ভিসে মানের পতন হচ্ছে, অথচ সশস্ত্র বাহিনী ‘এলিট’ রয়ে গেল।
যাক, যোগদান তো করলাম। পাকিস্তানি তিন-অক্ষরি সাহেবদের মতো দ্রুত উপরের সোপানে যাওয়ার আশায় থাকলাম। কিন্তু না, আমাদের ১৯৭৯-এর ১ মার্চ যোগদান করা এ ব্যাচের আগে মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচের বিশাল বাহিনী, অমুক্তিযোদ্ধা ব্যাচের অনেক, বিশেষ ইপিসিএস ১৯৭০-এর অনেক এবং ওগায়রা-ওগায়রা মিলে পদোন্নতি থমকে গেল। নিয়ম-কানুন পালন করে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে উন্নীত হলাম। কাজ কিন্তু সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের একই।
শুধু বেতন-ভাতায় বাড়তি সুবিধা। আমরা আটকে গেলাম। উপসচিব আর হতে পারি না। অবশেষ প্রায় ১৯ বছরে গিয়ে উপসচিব হলাম। বলতে লাগলাম, আমরা হলাম গিয়ে এডাল্ট ফ্রাঞ্চাইজের উপসচিব। কাজী রকীবউদ্দিন এবং ওমর ফারুক আমার উপসচিব ছিলেন, ড. আকবর আলি খানও, তারা তখন সচিব। তাদেরও যুগ্মসচিব হতে একটু দেরি হয়েছিল। প্রথম দুজন জিজ্ঞেস করলেন, বদিউর, এডাল্ট ফ্রাঞ্চাইজের উপসচিব আবার কী? বললাম, স্যার, ১৮ বছর বয়সে ভোটার হওয়া যায় তো, আমরা তো চাকরির প্রায় ১৯-এ গিয়ে উপসচিব হলাম, তা-ই এ নাম। তারা চুপ হয়ে গেলেন।
উপসচিব হতে চাকরিতে যোগদানের পর প্রায় ১৯ বছর লাগলেও আমি সিনিয়র সহকারী সচিব পদ নিয়ে বেশ খুশি ছিলাম। কারণ, আমি বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের বলেছিলাম যে, আমাদের সিনিয়র সহকারী সচিবের পদটি হলো একের ভেতর ছয় অর্থাৎ সিক্স ইন ওয়ান। আমি এক পদে থেকেই ছয় পদের অধিকারী-আমার প্রয়োজন মতো যখন যে পদে যেতে চাই, হয়ে যেতে পারি-শুধু তিনটা শব্দকে নিজের ইচ্ছামতো সাজিয়ে নিলেই হলো-যেমন আমি শুধু সচিব শব্দ রেখে সচিব হলাম, একইভাবে সিনিয়র সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী এবং সহকারী। অথচ সচিবের সচিব শব্দ বাদ গেলে তিনি কিছুই থাকেন না, অতিরিক্ত সচিবের সচিব বাদ দিলে তিনি অতিরিক্ত অর্থাৎ ‘ফালতু’, যুগ্মসচিবের সচিব বাদ গেলে শুধু ‘যুগ্ম’র তো কোনো মানে নেই, আর উপসচিবের সচিব বাদ গেলে ‘উপ’ শুনতে কী যে বিশ্রী লাগে, কেননা শুধু উপ দিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে খারাপ দিকে ইঙ্গিত করা হয়।
এক সময়ে তো যুগ্মসচিবরা মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্বও পালন করেছেন। ’৭০ ও ’৮০-এর দশকের প্রথমদিকেও ভারপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব হতেন, পরে অতিরিক্ত সচিব সচিববের দায়িত্ব পালন করলে তাকেও ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব বলা হতো। এখনকার মতো ভারপ্রাপ্ত সচিব বলা হতো না। তখন হয়তো পদবির বিষয়ে কর্তাবাবুরা বুদ্ধিমান ছিলেন না, এখন হয়েছেন। এরশাদের উপজেলা সৃষ্টির পর তো একসঙ্গে ৬৫০ জন নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে আরেক বহর সৃষ্টি করা হলো; তারপর ১৯৮৪ ব্যাচে ৪৫০ সহকারী কমিশনার, ১৯৮৫ ব্যাচে ৫৫০ সহকারী কমিশনার-বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার আরেক বেকায়দায় পড়ে গেল। আমি অতিরিক্ত সচিব ব্রিগেডিয়ার দেওয়ান সৈয়দ ইউসুফ হায়দার এবং সচিব মো. শামসুল হক চিশতীকে অনেক অনুরোধ করেও এত অধিকসংখ্যক কর্মকর্তাকে এক ব্যাচে না নিয়ে ক্যাডারের পদোন্নতি-সোপান সুষম রাখার এবং গুণগতমান উঁচুতে রাখার চেষ্টায় সফল হতে পারিনি। অনেক কষ্টে অবশ্য ১৯৮৬ ব্যাচে এ সংখ্যা কমাতে পেরেছিলাম।
পদোন্নতির নীতিতে সরকার আমাদের ১৯ বছর পর উপসচিব করলেও বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে পদবিহীন পদোন্নতি দিয়ে যে গণপদোন্নতি শুরু করা হলো, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরও তা আর থামেনি। ফলে গণপদোন্নতি আর ঘনপদোন্নতিতে মঞ্জুরিকৃত পদের থেকে অনেক অনেক বেশি পদোন্নতি দিয়ে কর্মকর্তাদের আপাত খুশি রাখতে পারলেও দায়িত্ব পালনে তাদের আগের নিচের পদেই থাকতে হয়েছে/হচ্ছে। প্রথম গণপদোন্নতির পরই শুরু হলো কর্তাবাবুদের বন্ধনীতে যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব লেখার রেওয়াজ। সরকারও আগের উপসচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব মর্যাদার পদগুলোকে আপগ্রেড করা শুরু করল। ফলে দেখা গেল, আমি সিনিয়র সহকারী সচিব হিসাবে যে পদে ছিলাম, পরে সেই একই পদে যুগ্মসচিবও পদায়ন পেয়েছেন।
পাকিস্তানি তিন-অক্ষরি সাহেবেরা বিদায়ের আগে, অভিযোগ রয়েছে, পরিকল্পিতভাবে সিভিল সার্ভিসটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছেন। কোনো কেবিনেট সেক্রেটারিই সিভিল সার্ভিসের উৎকর্ষ ধরে রাখতে সক্রিয় ছিলেন না, বরং তাদের প্রায় সবাই নিজের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আগ্রহী থেকে সিভিল সার্ভিসকে রাজনীতিকীকরণে সহায়তা করেছেন। ফল হয়েছে এখন এমন যে, ভোটের সময় সিভিল সার্ভেন্টদের কেউ আর দলীয়-লেজুড়ে ছাড়া ভাবতে পারেন না, বা চান না। আরও মজার ফল হয়েছে এই যে, এখন আমলারা নিজেরাই সরকারকে খুশি করার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্যই শুধু দেন না, রাজনীতিকদের অনেক সময় পাত্তাও দিতে চান না। আরও ফল হয়েছে এই যে, আমলাদের কনিষ্ঠজনেরাও এখন মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা দেখাচ্ছেন এবং আচরণে অকল্পনীয় অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছেন। সাম্প্রতিককালের বেশকিছু ঘটনা তারই প্রমাণ বহন করে।
গত ৩ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়-পদ নেই, কাজও আগের, তবু তাদের পদোন্নতি। প্রতিবেদনে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, জনপ্রশাসনে মোট কর্মকর্তা আছে ৫ হাজার ৯৭১ জন, অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত ২১২টি পদের সঙ্গে সমপর্যায়ের অন্যগুলো মিলে এ সংখ্যা ৩৩৭ হলেও অতিরিক্ত সচিব আছেন (১ অক্টোবর পর্যন্ত) ৪৩৩ জন। একইভাবে অনুমোদিত মোট পদের চেয়ে যুগ্মসচিব বেশি আছেন ২১৫ জন। উপসচিবের নিয়মিত হাজারখানেক পদের বিপরীতে আছেন ১ হাজার ৬৩৬ জন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত সচিব মঞ্জুরিকৃত পদের চেয়ে বেশি আছেন ৯৬ জন, যুগ্মসচিব বেশি আছেন ২১৫ জন এবং উপসচিব তো ৬৩৬ জন বেশি।
এভাবে চলতে চলতে এখন আর মঞ্জুরিকৃত শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়ার মূল নিয়মটাই অনিয়ম হয়ে গেল। আবারও আরও পদোন্নতির ব্যবস্থা হচ্ছে। সামনে নির্বাচন আছে, সরকার তো নির্বাচনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমলা ও পুলিশনির্ভর-তা গণভোটেই হোক, কিংবা নিয়মিত ভোটে। দিনের ভোট রাতে হতে হলেও প্রশাসন ও পুলিশের কর্তাদের ছাড়া সম্ভব নয়। ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে এমন মুখরোচক কথা ঢের আছে, কিন্তু লজ্জা তো নেই।
সরকার কাদের খুশি করার জন্য যে বেদরকারিভাবে সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করেছে, তা আমার মাথায় এখনো আসেনি। সচিব তো সচিবই, এখানে আবার সিনিয়র-জুনিয়রের কী আছে? অভিযোগ রয়েছে, সরকারের প্রিয়ভাজন কেউ কেউ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বা মুখ্য সচিব হতে পারবেন না দেখে একটা কোটারির জন্য সিনিয়র সচিবের একটা বাজে পদ সৃষ্টি করে সচিবদের মাঝে একটা বড় বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। এটা সিভিল সার্ভিসের জন্য শুভ হয়নি।
এক সময়ে একজনের জন্য মুখ্য অর্থ সচিব পদও সৃষ্টি করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের পদটাও সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের একটা পদই যথেষ্ট। জিয়া মশিউর রহমানকে (যাদু মিঞা) খুশি করার জন্য সিনিয়র মন্ত্রীর পদ করেছিলেন। এখন সরকার শূন্যপদবিহীন অতিরিক্ত আমলাদের জন্য সিনিয়র উপসচিব, সিনিয়র যুগ্মসচিব এবং সিনিয়র অতিরিক্ত সচিবের পদ সৃষ্টি করে সমস্যার একটি সুন্দর সুরাহা করতে পারে, আপনারা কী বলেন?
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান #