অগ্রসর রিপোর্ট:
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে নারীও। শত বাধা পেরিয়ে সব ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে স্বাবলম্বীও। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের সব ক্ষেত্রে এখন নারীর শক্ত অবস্থান। তবু সামাজিকভাবে বিভিন্ন দিক থেকে এখনো তারা দলিত। সন্তান জন্মের সময় এখনো প্রত্যাশায় থাকে ছেলে সন্তানের। অপ্রত্যাশিত রয়ে গেছে কন্যাশিশু।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সমাজ বা দেশে নতুন বা পুরোনো যে কোনো ধরনের অস্থিরতাতেই কন্যাশিশু ও নারীর ওপর নির্যাতন কমে না বরং তা সব সময় বাড়ে। এ নির্যাতন শুধু ঘরের বাইরেই নয়, নিজ ঘরেও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়তই ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সাধারণ মানুষকে করে তুলেছে আতঙ্কগ্রস্ত। নিজ দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্যাশিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। লঙ্ঘিত হচ্ছে কন্যাশিশু ও নারীর মানবাধিকার। একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কন্যাশিশুদের অধিকার, তাদের শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ নিশ্চিতকরণসহ নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। কন্যাশিশু কারও বোঝা নয়, বরং সম্পদে পরিণত হতে পারে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট আট মাসে ৭৬ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার তিনজন, অপহরণ ও পাচারের শিকার ১৩৬ জন, বাল্যবিয়ে হয়েছে ২ হাজার ৪৭৪ জনের, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার ১৩ জন, ধর্ষণের শিকার ৫৭৪ জন, গৃহশ্রমিক হিসেবে কর্মরত ১৫ জন শিশু নির্যাতনের শিকার, আত্মহত্যা করেছে ১৮১ জন, ১৮৬ জনকে হত্যা এবং ৮ কন্যাশিশুকে বিভিন্ন স্থানে ফেলে রেখে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া প্রতিদিন ৩০-৩৫ জন এবং মাসে ৯শ থেকে ১ হাজার কন্যাশিশু সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে।
গর্ভবতী মায়েদের ওপর চালানো পাঁচ বছর আগের এক জরিপ থেকে জানা যায়, গর্ভবতী নারীদের ৯০ শতাংশের প্রত্যাশা প্রথম সন্তান ছেলে হোক। এর পরের সন্তান ছেলে বা মেয়ে হলেও সেটি নিয়ে তেমন ভাবনা তার থাকে না। অনেকেই দুটি সন্তান হওয়ার পর আবার সন্তান নেন ছেলের আশায়। পরপর তিনটি মেয়ে হওয়ার কারণে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো ঘটনাও জরিপে উঠে এসেছে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি বলেন, গ্রামীণ পর্যায়ে ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করে ছেলেই আমার সব। মেয়েকে বিয়ে দিলে চলে যাবে, তার বিয়েতে খরচ করতে হবে এবং মেয়ে ভবিষ্যতে দেখাশোনা করতে পারবে না সেই ধারণা ৮০ শতাংশ মানুষের। শহরের দিকে এই ধারণা কিছুটা কম, ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করে সন্তান মেয়ে হোক আর ছেলে হোক সবাই সমান।
‘কন্যাশিশুরাও বড় হয়ে ভালো কিছু করতে পারে, মানুষের সেই ধারণা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। আমরা মনে করি মেয়েদের শিক্ষার হারও বেড়েছে। সরকারের দিক থেকে নেওয়া হয়েছে অনেক পদক্ষেপ। তবে এখনো কন্যাশিশুরা অনেকভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে, অভাব হচ্ছে তাদের নিরাপত্তার। সহিংসতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। বাল্যবিয়ে বেড়েছে, এটিকেও আমরা সহিংসতা বলবো। ধর্ষণও বেড়েছে, ডিজিটালি ভায়োলেন্স ইদানীং বেড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, পারিবারিকভাবেও কন্যা সন্তানের প্রতি যে বৈষম্য সেখানে তেমন পরিবর্তন হয়নি। ছেলেদের প্রতি পরিবারের যে দুর্বলতা সেটি এখনো আছে, এটি পরিবর্তনে সময় লাগবে। এটা দীর্ঘদিনের ধারণা যে ছেলেই ঘরের বাতি। সম্পত্তির ক্ষেত্রেও আইন বলে ছেলেসন্তান না থাকলে সম্পদ কন্যাসন্তান অনেক কম পাবে, সম্পত্তি চলে যাবে ভাই বা আত্মীয়দের কাছে। সেজন্য ছেলে সন্তান না থাকলে মানুষ ভীত হয়ে পড়ছে যে এই সম্পদ কে ভোগ করবে? ভবিষ্যতে ছেলেই হবে কর্ণধার, সে বৃদ্ধ বয়সে দেখবে এমন ধারণা পোষণ করেন অনেকে। বিষয়টি এখনো পাল্টানো যায়নি। কিছু পরিবারে ভাবনায় কিছু পরিবর্তন হলেও সেটির সংখ্যা কম।
দেশের একটি স্বনামধন্য গণমাধ্যমে কর্মরত মাসউদুল হক চার কন্যাসন্তানের জনক। তিনি বলেন, ‘আমি চার মেয়ের বাবা হিসেবে সত্যিই গর্বিত। আমি গর্ববোধ করি আমি চার মেয়ের বাবা। যার মেয়ে নেই তার সেই অনুভূতি হবে না। আমি মনে করি মেয়েসন্তান হওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের বিষয়। বর্তমান সময়ে মেয়েরা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এখন ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। আমি আমার চার মেয়েকে সেভাবেই যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবো। তারা যাতে ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকবো।’
এদিকে গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার কুসুম্বী ইউনিয়নের উঁচুলবাড়িয়া গ্রামে ১৪ মাস বয়সী ঘুমন্ত শিশুকে পুকুরে ফেলে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, সাত বছর আগে জাকিরের সঙ্গে পাশের নন্দীগ্রাম উপজেলার বুড়ইল ইউনিয়নের নামা সিংড়াপাড়া গ্রামে রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পর তাদের কন্যাসন্তান জন্ম হয়। জাকিরের প্রত্যাশা ছিল পরের সন্তান ছেলে হবে। কিন্তু পরের সন্তান মেয়ে হওয়ায় জাকির ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে রাবেয়া খাতুন ঘুম থেকে ওঠে দেখে তার দ্বিতীয় সন্তান হুমাইরা খাটে নেই। বিষয়টি বাড়ির লোকজনকে জানানো হলে তারা খোঁজাখুঁজি শুরু করে এবং জাকিরকে চাপ দিতে থাকে। পরে জাকির তার কন্যাশিশু হুমাইরাকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর শিশুটিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এ বিষয়ে মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ায় মধ্যযুগীয় কায়দায় তাকে পুকুরে ফেলে হত্যা করেছে বাবা। একটি সম্ভাবনাময় কন্যাশিশুর জীবনাবসান পরিবার, সমাজে বিদ্যমান পুরুষতন্ত্রের চরম বহিঃপ্রকাশ।
একই সঙ্গে সারাদেশে সংঘটিত নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান তারা। #