অগ্রসর রিপোর্ট: ক্যারিয়ারে প্রথমবার চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করে হেরে গেছেন চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার। জিতেছেন দুই মেয়াদে দায়িত্বে থাকা জায়েদ খান। তার তৃতীয় জয় এটি। কিন্তু তাকে চক্রান্ত করে হারানো হয়েছে বলে ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই অভিযোগ করে আসছেন নিপুণ। এ কথাও বলেছেন, জায়েদ খান টাকা দিয়ে ভোট কিনেছেন। একই অভিযোগ তিনি শুক্রবার ভোট চলাকালীনও করেছিলেন। এবার সংবাদ সম্মেলনে করলেন তার চেয়েও বিস্ফোরক অভিযোগ।
রবিবার বিকাল চারটায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদ। সেখানে নিপুণ ছাড়াও ইলিয়াস কাঞ্চন, চিত্রনায়ক রিয়াজ, ফেরদৌসসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। নিপুণ সেখানে তার বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। তার প্রথম অভিযোগ হলো- ভোটের দিন পরিচালক, প্রযোজক, ক্যামেরাম্যান ও টেকনিশিয়ানদের এফডিসিতে ঢুকতে না দেওয়া। এ জন্য তিনি এফডিসির এমডি নুজহাত ইয়াসমিন, নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা হারুন এবং জায়েদ খানের দিকে আঙুল তোলেন।
পীরজাদা হারুনের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে নিপুণ বলেন, ‘হারুন সাহেব আপনি এই কাজটা কেন করেছেন? কেন এক পক্ষকে টেনেছেন? কেন আপনি শুধু কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদকে চাপিয়ে গিয়েছেন। আরেক পক্ষের (মিশা-জায়েদ পরিষদ) কথা কেন রেখেছেন? আরেক পক্ষ চায়নি ১৭ সংগঠন এফডিসিতে ঢুকুক। আপনি সেটাই করেছেন। কিসের জন্য, কী স্বার্থ ছিল আপনার সেখানে? কেন আপনি ১৭ সংগঠনকে এফডিসিতে ঢুকতে দেননি?’
জায়েদ খানের টাকা দিয়ে ভোট কেনার প্রসঙ্গ টেনে পীরজাদা হারুনের উদ্দেশে নায়িকা বলেন, ‘আমি আপনার কাছে বারবার যাচ্ছিলাম যে, টাকা দিয়ে ভোট কেনা হচ্ছে। আপনি আমাদের কথা শোনেননি। আপনি জায়েদ খানকে নির্বাচন কমিশনে ডাকেননি। কেন ডাকেননি? কী স্বার্থ ছিল আপনার? প্রার্থীদের দাঁড়ানোর ব্যারিকেড দিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু জায়েদ খান কখনো সেই ব্যারিকেডের ভেতরে আসেনি।’
নিপুণের প্রশ্ন, ‘নিয়ম কানুন কি শুধু কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদের জন্য ছিল? অন্য পরিষদের জন্য ছিল না? পীরজাদা হারুন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, টাকা দেওয়ার কোনো অভিযোগ উনি পাননি। অথচ টাকা দিয়ে ভোট কেনার ভিডিও পুরো বাংলাদেশে ভাইরাল। আমাকে লোকজন ভিডিও পাঠাচ্ছে। আমি খুব সম্মান নিয়ে বলছি, যার ভিডিওটা আসলে ভাইরাল হয়েছে আমি খুবই দুঃখিত, তার কথা বলতে চাইনি। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি।’
অভিনেত্রী বলেন, ‘যে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল, নিয়ম ছিল আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকব, ভোটাররা হেটে যাবে, আমরা এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারব। কিন্তু জায়েদ ভোটারদের কাছে গিয়ে গলায় হাত দিয়ে কী দিচ্ছিলেন? সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরও পীরজাদা হারুন এখনও কোনো ডিসিশন নেননি। ওনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেন এখনও জায়েদের প্রার্থিতা বাতিল করা হচ্ছে না? নিয়ম আছে যে, যদি ভোটের সময় টাকা আদান-প্রদান হয়, তাহলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?’
পীরজাদা হারুন, এফডিসির এমডি এবং জায়েদ খানকে গ্যাং হিসেবে উল্লেখ করে নিপুণ বলেন, ‘তিনজনের এই গ্যাং মিলে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। যার কারণে আমাদের জীবনও নিরাপদ না। আমি বের হওয়ার সময় আমার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বনানী থানায় জিডি করেছি।’
তার কাছে কিছু টেক্সট আছে দাবি করে নিপুণ উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সেই টেক্সগুলো আমি আপনাদের দেখাবো। আমি আইজি সাহেবের কাছে অলরেডি টেক্সট পাঠিয়েছি। বলেছি, কার সঙ্গে এই টেক্সটগুলো আদান-প্রদান হয়েছে, কার দ্বারা এই কনস্পারেসি করেছে, আপনি সেগুলো বের করে জনগণের সামনে নিয়ে আসবেন। উনি এ ব্যাপারে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। সেই টেক্সটগুলো আপনাদের আজ আমি দেখিয়ে দেব।’
নিপুণের আরও দাবি, ‘আমি যেদিন থেকে বলে আসছি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এফডিসিতে আনতে চাই, সেদিন থেকে আমার বিপক্ষে কিছু লোক কাজ করছে। আজকে আসলে আমি হারিনি, হেরেছে পুরো বাংলাদেশ। পুরো বাংলাদেশ থেকে আমি যে ভোট পেয়েছি, সেটার সামনে জায়েদ খান নামের চক্রটা দাঁড়াতেই পারবে না। এই যুদ্ধটা আমি করেছি। তাই বলব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি শিগগির এফডিসিতে আসেন, চক্রকে ধরেন। এই চক্রকে না ধরলে চলচ্চিত্র বাঁচাতে পারবেন না।’
ভোটের দিন ১৭ সংগঠনের নেতাদের জায়েদ খান এফডিসিতে ঢুকতে দেননি বলে উল্লেখ করেন নিপুণ। তার কথায়, ‘এফডিসির এমডি বলেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢুকতে দেয় নাই। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে আমাদের বলা হয়েছে, আপনারা যে ডিসিশন নেবেন আমরা সে ভাবেই দায়িত্ব পালন করব। সেখানে জায়েদ খান বারবারই বলছিল, না ১৭ সংগঠনের কেউ এফডিসিতে ঢুকতে পারবে না। তার কিসের এত ভয় ছিল?’
নিপুণের অভিযোগ, ‘জায়েদ খান ৭৬টা পাস নিয়ে গেছে। আমরা একটা পাসও পাইনি। ভোটের দিন এফডিসিতে আমাদের একটা খাবারও ঢোকে নাই, জায়েদদের ৬০০ খাবার ঢুকেছে। আমাদের কোনো অ্যাসিসটেন্ট ঢুকতে পারে নাই, জায়েদ খানের দুই অ্যাসিসটেস্ট, মিশা ভাইয়ের দুই অ্যাসিসটেন্ট, মৌসুমী আপুর দুই অ্যাসিসটেন্ট তো ঠিকই ঢুকেছে। ছয়জন অ্যাসিসটেন্ট কীভাবে ঢুকল? তাহলে নিয়ম কানুন কি শুধু আমাদের জন্য?’
রবিবার প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিপুণের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল এবারের নির্বাচন কমিশনার অভিনেতা পীরজাদা শহীদুল হারুনের বিরুদ্ধে। তবে এই সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর ও বিস্ফোরক অভিযোগটা নায়িকা প্রকাশ করেন তার বক্তব্যের একেবারে শেষে।
নিপুণ বলেন, ‘পীরজাদার বিরুদ্ধে আরেকটা কথা বলতেই হবে। উনি ভোটের দিন সকালে আমার কাছে দুই গালে দুইটা কিস চেয়েছিলেন। ওই দুই গালের মধ্যে দুইটা চড় লাগানো উচিত ছিল। যেটা আমি সে সময় করি নাই। ওই সময় আমার দুই নারী প্রার্থী জেসমিন এবং শাহনূর সেখানে উপস্থিত ছিল, যখন উনি আমার কাছে কিস চেয়েছিলেন। তখনই ওনার গালে চড় দিয়ে আমার ইলেকশনটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল।’
তার অভিযোগগুলো তদন্ত করে পীরজাদা হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান নিপুণ। বলেন, ‘উনি একজন সরকারি চাকরিজীবী। সুষ্ঠু তদন্ত করে উনি যে চাকরিটা করেন সেটার উপরে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ এছাড়া তাকে এফডিসি এবং নাটক-সিনেমায় অবাঞ্ছিত ঘোষণার দাবিও জানান নায়িকা। পাশাপাশি এফডিসির এমডি নুজহাত ইয়াসমিনের সঙ্গে জায়েদ খানের কী সম্পর্ক, তা খুঁজে বের তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
গত শুক্রবার এফডিসিতে অনুষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ১৭তম নির্বাচন। সেখানে সাধারণ সম্পাদক পদে জায়েদ খানের কাছে ১৩ ভোটে হেরেছেন তিনি। এই পরাজয় মানেননি নিপুণ। তিনি শনিবার দুপুরে আপিল বোর্ডে লিখিত আবেদন করেছিলেন পুনরায় ভোট গণনার জন্য।
কিন্তু এদিন সন্ধ্যায় নিপুণের আবেদন পর্যালোচনা এবং পুণরায় ভোট গণনার পর আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান জানিয়ে দেন, নির্বাচন কমিশন থেকে ঘোষিত ফলাফলই ঠিক আছে। জায়েদ খানই জিতেছেন। তবে নিপুণ এখনও আত্মবিশ্বাসী তার পরাজয়ের পেছনে কোনো ‘চক্রান্ত’ আছে। তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন সেই চক্রান্তের রহস্য ভেদ করে শিল্পীদের দ্বিতীয় অভিভাবক হতে। এখন শেষপর্যন্ত কী হয় সেটাই দেখার।
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৪২৮ জন। ভোট দেন ৩৬৫ জন শিল্পী। এর মধ্যে ১০টি ব্যালট বাতিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ২০২২-২৪ মেয়াদের এই নির্বাচনে সভাপতিসহ ১০ পদে জয় পেয়েছে কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদ। অন্যদিকে, সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১১টি পদ দখল করেছে মিশা-জায়েদ প্যানেল।