জাস্টিন ট্রুডো কানাডার ইতিহাসে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হলেন ৪৩ বছর বয়সে। তার নবগঠিত মন্ত্রিসভা গঠনে একটার পর একটা বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য বিশ্বে বিস্ময়ের তরঙ্গ তুলেছে। জাস্টিন ট্রুডোর কয়েক দশক আগে জো ক্লার্ক মাত্র ৩৯ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হয়ে কানাডার ইতিহাসে একটি অনন্য স্থানে রয়েছেন।
একটা বিস্ময় যেটা বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে হয়তো সর্বাধিক বিস্মিত এবং কিছুটা অপ্রতিভও করে তুলেছে সেটা হলো, জাস্টিন ট্রুডো তার ২৮ সদস্যের মন্ত্রিসভায় চারজন শিখকে মন্ত্রী করেছেন, যে সময় শিখদের মূল দেশ ভারতের মন্ত্রিসভায়ও দু’জনের বেশি শিখকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি!
এর ওপরেও একটি বিস্ময় হচ্ছে, পাশ্চাত্যের অন্যতম শক্তিশালী দেশ কানাডার দেশরক্ষামন্ত্রী করা হয়েছে হরজিৎ সাজ্জান নামে একজন শিখকে। হরজিৎ কানাডার সেনাবাহিনীতে বীরত্বের জন্য মেডেল লাভ করেছেন এবং লে: কর্নেল পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর ১১ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। কানাডার তিন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল, অ্যাডমিরাল ও এয়ার ভাইস মার্শাল (যারা সবাই শ্বেতাঙ্গ) শিখ দেশরক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত হবেন!
আরো যে তিনজন শিখকে মন্ত্রী করা হয়েছে তারা হলেন- নবদ্বীপ বেইনস শিল্প মন্ত্রণালয়; বারদিস চা¹ার পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং অমরজিৎ সোহি অবকাঠামো ও কমিউনিটি মন্ত্রণালয়।
বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য যে বৈশিষ্ট্য আনন্দমিশ্রিত বিস্ময় এনেছে, তা হলো ট্রুডো মন্ত্রিসভায় একজন মুসলিম মহিলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মরিয়ম মুনসেফ নামে এই মহিলা ১১ বছর বয়সে প্রাণ বাঁচানোর জন্য আফগানিস্তান থেকে রিফিউজি হয়ে কানাডায় আগমন করেন এবং লেখাপড়া করে কানাডায় তার জীবন গড়ে তুলেছেন। তাকে ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মন্ত্রণালয়’-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ট্রুডোর মন্ত্রিসভার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ও বিস্ময় হচ্ছেÑ সমানসংখ্যক পুরুষ ও নারীকে মন্ত্রী করা হয়েছে। শপথ গ্রহণের পর প্রথম সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ট্রুডোকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি কিভাবে পুরুষের সমসংখ্যক নারীকে মন্ত্রিসভার সদস্য করার সিদ্ধান্তে এলেন? ট্রুডো এর স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, ‘এটা ২০১৫ সাল। এ কথা আপনাদের মনে রাখতে হবে।’ তার এই স্মার্ট তাৎক্ষণিক উত্তর সারা বিশ্বে সোশ্যাল মিডিয়াতে নন্দিত হচ্ছে।
শপথ নিয়েই প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিস্ময় সৃষ্টি করলেন! তিনি প্রথম সাক্ষাৎকার দিলেন সাংবাদিক অথবা কর্মকর্তাদের নয়, প্রথম সাক্ষাৎকার দিলেন কানাডাব্যাপী উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলোর মধ্যে পাঁচটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ‘গুগল কনফারেন্স কল’-এর মাধ্যমে। কানাডা যার পূর্ব থেকে পশ্চিমে ব্যাপ্তি হচ্ছে ঢাকা থেকে ইরাকের বাগদাদ পর্যন্ত এবং সময়ের ব্যবধান তিন ঘণ্টা, সেই কানাডার কাছের ও দূরান্তের পাঁচটি বিদ্যালয় ট্রুডোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ট্রুডো ‘কনফারেন্স কল’ শুরু করেন চারটি শব্দ দিয়ে : ‘আমি প্রধানমন্ত্রী বলছি’।
ভালো রাজনীতিকের কর্তব্য
এরপর কানাডাব্যাপী বিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীরা এক এক করে প্রশ্ন করে এবং ট্রুডো উত্তর দিতে থাকেন। নোভা স্কশিয়া প্রদেশের কিশোর ছাত্র আলেক্সিস জিজ্ঞাসা করে : তুমি তো আগে শিক্ষকতা করেছিলে। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তুমি প্রধানমন্ত্রীরূপে কিভাবে কাজে লাগাতে পারো?
ট্রুডোর উত্তর : ‘ভালো শিক্ষক তিনি নন যিনি ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। ভালো শিক্ষক তিনিই যিনি ছাত্ররা কী সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে তার খবর রাখেন এবং এগুলোর সমাধান কিভাবে করতে হবে তা বুঝিয়ে দেন।
ট্রুডো বলেন, ‘আমি মনে করি, একজন ভালো রাজনীতিকও তা করে থাকেন। শুধু প্রশ্নের জবাব দেয়া ভালো রাজনীতিকের কাজ নয়। ভালো রাজনীতিক তিনি যিনি নিশ্চিত করেন যে, নাগরিকেরা যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে তা সমাধান করার জন্য তিনি নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা দিচ্ছেন, যাতে তারা নিজেরাই সেসব চ্যালেঞ্জের সমাধান ও উত্তর পায়।’
১৯ অক্টোবর কানাডার সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিকে এসে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানমন্ত্রী হার্পার নিজের দলের জনসমর্থনে ধস দেখতে পেয়ে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন ধরে রাখার জন্য মুসলিম মহিলাদের হিজাব-নিকাব পরার বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ ঘোষণা করেন। তখন তিনি বলেন, পুনঃনির্বাচিত হলে তিনি কানাডার সরকারি অফিসগুলোতে হিজাব-নিকাব নিষিদ্ধ করবেন এবং হিজাব-নিকাব পরা কাউকে যেন সরকারি অফিসগুলোতে কোনো সার্ভিস দেয়া না হয় সে সিদ্ধান্ত দেবেন।
লিবারেল জাস্টিন ট্রুডো ব্যাপক জনসমর্থন বিশেষ করে মুসলিমদের একচেটিয়া ভোটে সংসদে মেজরিটি পেয়েছেন বলে ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই যে হিজাব পরা মুসলিম মহিলা ট্রুডোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সেলফি তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস ৩১ অক্টোবর সংখ্যায় সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার শীর্ষে তার সে ছবি ছাপিয়ে লিখেছে, ‘তার বিজয়ের পরে জাস্টিন ট্রুডোকে দেখা গেল হিজাব পরা মহিলাদের সাথে সেলফি তুলছে, হিন্দুদের সাথে নৃত্য করছে এবং মুসলিমদের সাথে আহার করছে।’
শিখদের ভাষা ‘পাঞ্জাবি’ এখন কানাডার পার্লামেন্টে তৃতীয় ভাষার (ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষার পর) মর্যাদা পেয়েছে। ৩৩৮ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে ১৯ জন ভারতীয়-কানাডীয় নির্বাচিত হয়েছেন যাদের বেশির ভাগই শিখ ধর্মাবলম্বী।
আরেকটি বিস্ময় : ট্রুডোর মন্ত্রিসভায় কমপক্ষে ১১ ভাষাভাষী সংসদ সদস্য মন্ত্রী হয়েছেন। ভাষাগুলো হচ্ছেÑ ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, ফার্সি, দারি (আফগানিস্তানের প্রধান ভাষা), আরবি, পাঞ্জাবি, হিন্দি, উর্দু, ইউক্রেনিয়ান, পোলিশ ও ইতালীয়। আর কোনো দেশে মাত্র ২৮ জন সদস্যের মন্ত্রিসভায় ১১ ভাষাভাষীর মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে জানা যায় কি?