অগ্রসর রিপোর্ট :মিয়ানমারে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে, তা কয়েক দিন আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ অন্যরা এ বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তার পরও দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এখন বিশ্লেষকরা হিসাব করে দেখছেন, এই সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনের কারণ কী, আর কে বা কারা এর মাধ্যমে লাভবান হবেন।
২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে নতুন কমান্ডার ইন চিফের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে মিয়ানমারের বর্তমান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেইংর। অভ্যুত্থানের পেছনে অবশ্যই এই সেনা জেনারেলের আর্থিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। সেনাপ্রধান হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিস্তর অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তিনি ও তার পরিবার এই প্রভূত ধনসম্পদ হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।
মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি) এবং মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড (এমইএইচএল)-এর মতো বিশাল দুটি সামরিক প্রতিষ্ঠানের মূল কর্তৃত্ব সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেইংয়ের হাতে।
মিয়ানমারের শেয়ার ব্যবসার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এমইএইচএল-এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেডের প্রধান একক কর্তৃত্ববাদী প্রধান জেনারেল হ্লেইং।
সেনা ডিক্টেটরদের তত্ত্বাবধানে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে জনগণের সম্পদ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লুটপাটের জন্য। এই প্রতিস্ঠানের প্রধান জেনারেল হ্লেইং।
এই প্রতিষ্ঠানটি অসৎ আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে জেনারেল হ্লেইংয়ের তত্ত্বাবধানে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৩ সালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার পোর্ট অথরিটির হাত থেকে বো অং কাইআও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয় এমইএইচএলের হাতে। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে এই দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় কেটি গ্রুপের হাতে। গ্রুপটি এর বিনিময়ে এমইএইচএলের হাতে বছরে তুলে দেবে তিন মিলিয়ন ডলার। মিয়ানমার নাও পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, প্রতি পাঁচ বছর পরপর পুনর্বিবেচনাযোগ্য এই চুক্তির মেয়াদ ৫০ বছর। একইভাবে নদী-তীরবর্তী আহলন টাউনশিপ আবাসিক এলাকার নিয়ন্ত্রণ এমইসি-এর হাতে।
জেনারেল হ্লেইংয়ের নেতৃত্বে দেশের খনিজ সম্পদ ব্যবসায়ও একছত্র কাজ করছে এমইএইচএল। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যবসা (খনি) থেকে বেশ কিছু ব্যবসা কেজিজেড গ্রুপের হাতে তুলে দিয়েছে। মিয়ানমার এক্সট্রাকটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ ট্রান্সপারেন্সির প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
খামতি অঞ্চলে এমইএইচএল কেবিজেড গ্রুপকে রত্ন অনুসন্ধানে লাইসেন্স দেয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠান ২৪ হাজার ২৩০ কেজি রত্ন উত্তোলন করে। এর বিনিময়ে তারা খুব সামান্য রাজস্ব দিয়েছে।
সাগাইং অঞ্চলে তামার খনিতে উত্তোলনে নিয়োজিত আছে ওয়ানবাও মাইনিং অ্যান্ড ইয়াং সি কোম্পানি। এটি চীনের অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নরিনকো-এর একটি অঙ্গ বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান। খনিতে অনুসন্ধান কাজ চালানোতে ওই অঞ্চলে ব্যাপক পরিবেশদূষণের ঘটনা ঘটেছে।
এমইএইচএল-এর তথ্যমতে, খনিজ সম্পদ ব্যবসায় সাবাই তাউং অ্যান্ড কায়া সিন তাউং-এর বিনিয়োগ ৩৯৮ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার। এর শতভাগ অর্থই এসেছে ইয়াং সির কাছ থেকে। লেতপাদাউং খনিজ সম্পদে ৯৯৭ মিলিয়ন ডলারের পুরোটাই বিনিয়োগ করেছে ওয়ানবাও। ওয়ানবাও মাইনিং অ্যান্ড মিয়ানমার ইয়াং সি প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দুটি খনির একটিতেও বিনিয়োগ না করে এই সব ব্যবসা থেকে বিরাট অঙ্কের মুনাফা পাবে জেনারেল অং হ্লেইংয়ের নেতৃত্বাধীন এমইএইচএল।
দুর্নীতিপরায়ণ এসব অসৎ চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে জেনারেল হ্লেইং ব্যক্তিগতভাবে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। বিদেশের এই অসৎচক্র সব সময় পেছন থেকে এই জেনারেলকে সহযোগিতা করে এসেছে। এমনভাবে এই অর্থবিত্ত হাতিয়ে নেয়া হয়, যেখানে সাধারণের অংশগ্রহণ থাকে না, থাকে গুটিকয়েক জেনারেল ও তাদের কাছের লোকজন। নিয়মতান্ত্রিক পন্থাকে অবলম্বন করে বেআইনি ব্যবস্থায় এই জেনারেল সেনাসম্পত্তি, বিভিন্ন লাইসেন্স প্রদান ও সরকারি কেনাকাটা থেকে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন।
জেনারেল মিন অং হ্লেইং পরিবারের ব্যবসা-বাণিজ্য
পরিবারের জন্য অবৈধভাবে ধনসম্পদের পাহাড় গড়তে এই জেনারেল ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। সেনা প্রভাব খাটিয়ে ও এর মাধ্যমে দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে তিনি নিজ পরিবারকে ধনী করেছেন।
জেনারেল মিন অং হ্লেইংয়ের ছেলে অং পাইয়ে সোনে অনেকগুলো প্রকাশ্য ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে রয়েছে মেডিকেল সাপ্লাই ব্যবসা, খাদ্য ও কমিশন ব্যবসা, ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লাইসেন্স পাইয়ে দেয়ার ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানি, ফার্মাসিউটিক্যাল এবং মেডিকেল টেকনোলজির ব্যবসা।
শোয়েডাগন প্যাগোডা-সংলগ্ন পিপলস পার্কে ইয়াঙ্গুন গ্যালারি ও ইয়াঙ্গুন রেস্টুরেন্টের মালিকানা নিয়ে প্রথম প্রকাশ্যে আলোচনায় আসেন অং পাইয়ে সোনে। ইয়াঙ্গুন আঞ্চলিক সরকার তাকে কৃত্রিমভাবে তৈরি একটি নিচু এলাকা দেয়। তিনি আজুরা বিচ রিসোর্টের মালিক। বিজ্ঞাপনে এই রিসোর্টকে চাউং থা এলাকার সবচেয়ে বড় রিসোর্ট বলে দাবি করা হয়।
২০১৫ সালের নির্বাচনে এনএলডির বিজয়ের পর মিয়ানমার ইনভেস্টমেন্ট কমিশন ২২ দশমিক ২২ একর জায়গার ওপর রিসোর্ট নির্মাণের জন্য স্কাই ওয়ান কনস্ট্রাকশনের জন্য পারমিট অনুমোদন করে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক অং পাইয়ে সোনে।
২০১৬ সালে মার্ক-ইউ হোটেল উন্নয়নের জন্য মিয়ানমারের হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উইনিং স্টার কোম্পানির জন্য ২৫০ মিলিয়ন কিয়েতের কাজ দেয়া হয়। উইনিং স্টার কোম্পানির মালিক স্কাই ওয়ান কনস্ট্রাকশনের অংশীদার। আরাকান রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পুরোনো রাজধানী মার্ক-ইউ। আরাকন আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে গত বছর মার্ক-ইউ অঞ্চলে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে।
অং পাইয়ে সোনের স্ত্রী মায়ো ইয়াদানার হেইক নিজেও ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট। স্বামীর সঙ্গে তিনিও নিয়েন চ্যান সোনে ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির একজন পরিচালক।
দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসেবে পরিচিত অং মাইন থু গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাপাওয়ারের একজন পরিচালক ছিলেন জেনারেল হ্লেইংয়ের পুত্রবধূ মায়ো। ইয়াঙ্গুনের মিংগালাডন টাউনশিপে একটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসার পরিচালনা করে অ্যাপওয়ার।
জেনারেল মিস অং হ্লেইংয়ের মেয়ে থিন থিরি থেট মন মিডিয়া হাউস সেভেন সেন্স-এর মালিক। এই প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র ব্যবসায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে থাকে। উদীয়মান ও বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগকারী বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির ব্যবসার সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অভিজাত রত্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ইভারফিটের মালিকও জেনারেল হ্লেইংয়ের মেয়ে।
এসব পারিবারিক ব্যবসার লভ্যাংশ হিমশৈলের সামান্য চূড়া মাত্র। যত দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক নজরদারির বাইরে থাকবে এবং জেনারেল হ্লেইং তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকবেন, তত দিন পর্যন্ত এই পরিবারের সম্পদের পরিমাণ অনুমান করা যাবে না।
সামরিক অভ্যুত্থান থেকে কে লাভবান হবে?
জেনারেল অং হ্লেইং যখন হুমকি দেন মিয়ানমারের নির্বাচনী ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন ও সমুন্নত রাখার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের প্রয়োজন রয়েছে, তখন কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পরিচালনাধীন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান ও পরিবারের সদস্যদের ব্যবসা-বাণিজ্য সমন্বয়ে জেনারেল হ্লেইংয়ের ভূমিকা কী থাকবে।
এই জেনারেলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশ-বিদেশে প্রচণ্ড সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক অংশীদার কিরিন হোল্ডিংস এবং প্যান প্যাসিফিকের কাছে।
গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ব্যবসাসংশ্লিষ্ট নিয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টের পর ২০১৯ সাল থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে জেনারেল মিন অং হ্লেইংয়ের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত নাম জেনারেল জেনারেল মিন অং হ্লেইং।
এই জেনারেলের অধীনে নির্বিচার দুর্নীতি ও হীনস্বার্থের টানাপোড়েনে মিয়ানমারের জনগণ ও সেনাবাহিনী লাগাতার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
মিয়ানমারে যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থকে এবং অপরাধের জবাবদিহি নেয়া শুরু হয়, তাহলে এই জেনারেল ও তার পরিবারের অর্থপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। লুণ্ঠন করা জনগণের সম্পদ তখন জেনারেল হ্লেইংকে আবার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের জবাবদিহির আওতায় না আসা পর্যন্ত জেনারেল হ্লেইং সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিজের অবস্থান সুসংহত রাখার চেষ্টা করবেন। জনগণের সম্পদ চুরি করে নিজ পরিবার ও সেনাবাহিনীর কাছের লোকজনকে আর্থিকভাবে লাভবান করার ব্যবস্থা করবেন। যেখানে মিয়ানমারের বেশিভাগ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর বেশিভাগ র্যাঙ্ক অ্যান্ড ব্যাজের কর্মকর্তা-কর্মচারী দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন করে।
সামরিক অভ্যুত্থান দেশের জনগণ ও সৈনিকদের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। বরং এটি জেনারেল হ্লেইং ও তার পরিবারকে লাভবান করবে, আরো অর্থসম্পদের মালিক করবে। তার আরো রয়েছে রাজনেতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তাহলে সামরিক অভ্যুত্থান থেকে প্রকৃত অর্থে কে লাভবান হচ্ছে?
সূত্র: জাস্টিস ফর মিয়ানমার