অগ্রসর রিপোর্ট : বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলংকায় মুসলিম ও খ্রিষ্টধর্মের নাগরিকরা করোনায় মৃত প্রিয়জনদের মরদেহ ধর্মীয়রীতিতে সৎকার করতে পারছেন না। তাদের লাশ দাহ করা হচ্ছে। এতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে এই দুই ধর্মের মানুষসহ শ্রীলংকার নাগরিকদের মধ্যে। বাড়ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর উদ্বেগ।
শ্রীলংকায় এখন পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ১৮৬ জন। এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ করোনা মৃত্যু হওয়া মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মরদেহ সৎকারে এমন পথ অবলম্বন করছেন যাতে উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের সমর্থন রয়েছে। সম্প্রতি ২০ দিনের এক শিশুকে বাবা-মা’র অসম্মতিতে জোর করে দাহের ঘটনা শ্রীলংকায় মুসলিমদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দেয়। করোনায় যে ৮০ জন মুসলিম মারা গেছেন তাদের মরদেহও ধর্মীয় মর্যাদায় সৎকার করা হয়নি।
মুসলিম অধিকারকর্মী শ্রিন সারোর বলেন, মুসলিমদের এমন সময় এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে, যখন তাদের কাছের কারো মৃত্যুতে শোক করার সময়। আত্মীয়-স্বজনরা পাপ ও অপরাধবোধের মাঝে চাপা পড়ছে। কারণ দাহ করা পাপ।
তবে সংবিধান সংশোধনের ফলে একনায়কের মতো ক্ষমতা উপভোগ করা রাজাপক্ষ যুক্তি দিচ্ছেন, লাশ দাহ করলে করোনাভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে না। দাফন করলে মাটি ও পানিতে ভাইরাস ছড়াতে পারে। কবরে মরদেহ দাফনকে জৈবিক অস্ত্রের সঙ্গেও তুলনা করেন তিনি।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকালে মরদেহ সৎকার নিয়ে ইতোমধ্যে নিয়ম-কানুন বিষয়ে জানিয়েছে। আরো ঘোষণা করেছে করোনায় আক্রান্ত মৃতদের সৎকার ধর্মীয় রীতির বিষয়। সংস্থাটির ১৮০টি দেশও এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়েছে।
করোনায় মৃত মুসলিমদের দাহ করার এই সিদ্ধান্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো। এমন পদক্ষেপের জন্য শ্রীলংকাকে ভুগতে হতে পারে। মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি ইতোমধ্যে শ্রীলংকার এই পদক্ষেপে উদ্বেগ জানিয়েছে।
শ্রীলংকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক হানা সিঙ্গার রাজাপক্ষকে লেখা এক বার্তায় বলেন, আমার মনে হচ্ছে দাফন করতে না দেওয়ার কারণে সমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
২০২১ সালের প্রথম দিকে জেনেভায় শ্রীলংকা যুদ্ধপরবর্তী মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন তুলে ধরবে। ওআইসি সদস্যরা শ্রীলংকাকে অতীতে অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সমর্থন দিলেও এবার তা নাও দিতে পারে বলে জানিয়েছেন শ্রীলংকার মুসলিম কাউন্সিলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিলমি আহমেদ।
তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের সঙ্গে শ্রীলংকা সরকারের প্রায় ত্রিশ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষ হয় ২০০৯ সালে। এতে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা গেছেন, নিখোঁজ রয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি। শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। মুসলিমদের মরদেহ দাহের ঘটনা যুদ্ধপরবর্তী শ্রীলংঙ্কার গোষ্ঠীগত বিভেদ আরো স্পষ্ট করেছে।
গোতাবায়া রাজাপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রীলংঙ্কায় আন্দোলন হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে পশ্চিমাবিশ্ব থেকেও। আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৌদ্ধ, হিন্দু, ক্যাথলিক, খ্রিস্টান, মুসলিমসহ সব ধর্মের মানুষই রয়েছেন। সাদা একটু কাপড় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আন্তঃধর্মীয় সহমর্মিতার নিদর্শন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
রুখি ফার্নান্দো নামের এক ক্যাথলিক মানবাধিকার কর্মী বলেন, এই বিষয়টি এখন আর শুধু মুসলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ঐক্য আর উপলব্ধি আরো বেশি। সরকারকে হয়তো জেনেভায় তা মোকাবিলা করতে হবে।