ইমদাদুল হক মিলন- রাজন হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখিনি। দেখা সম্ভব ছিল না। আমার ড্রাইভার খানিকটা দেখে কাঁদতে কাঁদতে বন্ধ করে দিয়েছিল। পত্রিকায় যেসব ছবি ছাপা হয়েছে তা দেখেই দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলাম। সারাটা সকাল চেষ্টা করেছি রাজনকে নিয়ে লিখি, লিখতে পারিনি। হাত-পা কাঁপছিল। রাজনের অসহায় কান্নাকাতর মুখ, মার ঠেকাবার প্রাণপণ চেষ্টা, আর বাঁচার তীব্র আকুতি… না, আমি আর ভাবতে পারি না।
এ কোন হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে মানুষ? অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শিশুকে। বড় অঙ্কের মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে। অসহায় মা-বাবা মুক্তিপণের ব্যবস্থা করলেন। তার পরও ফিরে পেলেন না বুকের মানিক। হত্যা করা হলো শিশুকে। এ রকম কত ঘটনা ঘটছে। শিশুর গলাকাটা লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদী, ডোবানালা আর জঙ্গলে। কত রকম অত্যাচারে হত্যা করা হচ্ছে তাদের। সাততলা থেকে ফেলে বাবা হত্যা করছেন শিশুকে, মা বিষ খাইয়ে হত্যা করছেন দুই শিশুকন্যাকে। পরকীয়ার কারণে এক মা তাঁর শিশুকে হত্যা করে ফ্রিজে ভরে রেখেছিলেন। এ রকম কত উদাহরণ দেব?
কী শুরু হয়েছে এসব? আমরা কি মানুষ? কোনো জন্তুও কি নিজে এভাবে হত্যা করে আপন শিশুকে? যারা মেতে উঠেছে এ রকম পৈশাচিক শিশু হত্যায় তারা তো মানুষ নয়ই, তাদেরকে যদি জন্তুর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে জন্তুর অপমান হবে। যে রকম নৃশংস, পৈশাচিক আর বর্বর শিশু হত্যায় মেতে উঠেছে কিছু মানুষ (!) তারা জন্তুরও অধম। একটি ৯-১০ বছর বয়সী শিশুর লাশ পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিক্যালের সামনের রাস্তায়। স্যুটকেসে ছিল লাশ। নির্মমভাবে হত্যা করা শিশুটির ক্ষতবিক্ষত লাশ তাকিয়ে দেখা সম্ভব নয় কোনো মানুষের পক্ষে। হত্যা করার আগে যে কুৎসিত নির্যাতন করা হয়েছিল ছেলেশিশুটিকে, সভ্য হয়ে ওঠার আগেও মানুষ কখনো শিশুর ওপর এ রকম নির্যাতন চালিয়েছে বলে মনে হয় না।
এ কোন পরিস্থিতিতে পড়েছি আমরা? রাজন হত্যাকাণ্ডের পর ঘটল রাকিব হত্যাকাণ্ড। খুলনার একটি গ্যারেজে যে পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে রাকিবকে, পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেকোনো মানুষ এ ঘটনা জেনে স্তব্ধ হবে। কোনো কোনো মানুষের হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এমন কাজও করতে পারে মানুষ! ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি আর তাদের দোসররা মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করেছে শত শত শিশুকে। অগ্নিকুণ্ডে ছুড়ে ফেলেছে কাউকে, হাত-পা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে কোনো কোনো শিশুর। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় বাঙালি মায়ের কোল থেকে শিশু কেড়ে নিয়েছে বিহারিরা। সেই শিশুকে ছুড়ে দিয়েছে আকাশের দিকে, তারপর বর্শা কিংবা তলোয়ার উঁচিয়ে ধরেছে, শিশুটি গেঁথে গেছে তাতে। কোনো কোনো বাঙালি শিশু বর্শায় গেঁথে বীভৎস উৎসব করেছে নরকের ওই সব কীট। আজ স্বাধীনতার এতকাল পর এ দেশের শিশু হত্যাকারীরা সেই বর্বরদেরও ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থা কিছুতেই চলতে পারে না। এ দেশের একটি শিশুও আর হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে না। আমরা প্রতিরোধ করব, যে যার জায়গা থেকে প্রতিরোধ করব। যার যেটুকু শক্তি, সেই শক্তি নিয়ে প্রতিরোধ করব। রাজন হত্যাকাণ্ডের পর জেগে উঠেছে রাজনের গ্রাম, রাজনের এলাকা। প্রতিটি মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, প্রতিবাদ করছে। অপরাধী সন্তানকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন মা-বাবা। রাজন হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে মুখর হয়েছে সারা দেশ। অপরাধীরা ধরা পড়ছে। দ্রুত বিচারের অপেক্ষায় আছি আমরা।
রাকিবকে নিয়েও একইভাবে সোচ্চার হয়েছে মানুষ। অপরাধীদের ধরে পুলিশে দিয়েছে। তাদের বিচারের দাবিতে পথে নেমেছে। আমাদের প্রধান শক্তি হচ্ছে যেকোনো বিপদের কালে পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়াই আমরা। পথে নামি, সোচ্চার হই, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করি। তখন আমাদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ থাকে না। আমরা বিপদ মোকাবিলা করি সম্মিলিতভাবে। এখন আমাদের এক বিপৎকাল, আমরা আমাদের শিশুদের হারাচ্ছি। এ অবস্থা কিছুতেই চলতে দেওয়া যাবে না। আমরা শিশু হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। প্রতিটি শিশুকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করব।
পরম করুণাময়, আমাদেরকে শক্তি দাও। আমরা যেন আমাদের শিশুদেরকে অপঘাত, অপমৃত্যু আর হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা করতে পারি। নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারি। আর রাজন-রাকিবের মতো যারা চলে গেছে, তোমার সেই সুমহান জগতে তুমি তাদেরকে বুকে করে রেখো।