মহানবী (সা.)-এর পরিবার ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শস্বরূপ। পারিবারিক জীবনে তারাই ছিল শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। আর নবীজি (সা.) তাদেরকে মুসলিম জাতির ‘শিক্ষকরূপেই প্রস্তুত করেছিলেন’। সুতরাং রমজানে নবীজি (সা.)-এর স্ত্রী-পরিবারের আমলগুলো উম্মাহর জন্য অনুসরণীয়।
তাদের সময় ছিল ইবাদতমুখর। মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী-পরিবার রমজানে অধিক পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী হতো। তারা রমজানে নফল ইবাদত, তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত ও দান-সদকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিত। তারা পানাহার ও খাবারের বাহারি আয়োজনে লিপ্ত হয়ে সময় নষ্ট করত না। মহানবী (সা.)-এর পারিবারিক শিক্ষা তুলে ধরে হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানি (রহ.) লেখেন, ‘রাসুল (সা.) রমজানে অধিক পরিমাণ ইবাদত করতেন।
এই সময় পরিবারের সবাইকে ইবাদতে অংশ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। রমজানের শেষ ১০ দিন অবশিষ্ট থাকাকালে রাসুল (সা.) নামাজ পড়তে সক্ষম এমন সবাইকে নামাজে দাঁড় করিয়ে দিতেন।’ (ফাতহুল বারি : ৪/৩১৬)
কেমন ছিল তাদের রমজান
রমজানে নবীজি (সা.)-এর পূতঃপবিত্র স্ত্রীদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আমল তুলে ধরা হলো:
১. তাহাজ্জুদ ও তারাবির নামাজ: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীরা রমজানে অধিক পরিমাণ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। তাঁরা তারাবির নামাজেও অংশ নিতেন।
এমনকি তাঁরা অন্য মুসলিম নারীদের দ্বিনি বিধান শেখাতেন, তাঁদের মধ্যে দ্বিনের দাওয়াত পৌঁছে দিতেন। আয়েশা (রহ.)-এর ব্যাপারে এসেছে, ‘তিনি রমজানে নারীদের নফল নামাজের ইমামতি করতেন এবং তাদের মাঝে দাঁড়াতেন।’ (আল মাজমু লিল-নববী : ৪/১৮৭)
হানাফি মাজহাবের ইমামরা বলেন, আয়েশা (রা.) এমনটি করেছেন নারীদের নামাজ শেখাতে। নতুবা নারীদের ইমামতি বিধিবদ্ধ নয়।
২. সম্মিলিত ইবাদত: রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানে তাঁর পরিবার-পরিজনদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে ইবাদত করতেন।
যেমন সিরাত গ্রন্থে এসেছে, ‘রমজানে নবীজি (সা.) তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের একত্র করতেন এবং তাদের নিয়ে রাতের নামাজ আদায় করতেন।’ (আল আতিক, পৃষ্ঠা ২০৮)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) রাত জেগে ইবাদত করতেন, তাঁর পরিবারকে ডেকে দিতেন এবং লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৪)
৩. তিলাওয়াত ও জিকির: রমজানে নবীজি (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীদের প্রিয় আমল ছিল অধিক পরিমাণ তিলাওয়াত ও জিকির করা। সিরাত গ্রন্থগুলোতে এসেছে, তাঁরা রমজানে অধিকবার কোরআন খতমের চেষ্টা করতেন। কেননা এটা ছিল নবীজি (সা.)-এর প্রিয় আমল। ফাতেমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তার পিতা তাকে বলেছে, প্রতি রমজানে জিবরাইল (আ.)-কে একবার কোরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। কিন্তু মৃত্যুর বছর তিনি তাকে দুইবার কোরআন শোনান। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৮৫)
৪. দান করা: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীরা অধিক পরিমাণ দান করতে ভালোবাসতেন, বিশেষত রমজান মাসে। জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.) ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল। তিনি নানা ধরনের হস্তশিল্পে পারদর্শী ছিলেন। আর তা থেকে উপার্জিত অর্থ তিনি অসহায় মানুষকে দান করতেন। আয়েশা (রা.)-এর দানশীলতাও ছিল সুপ্রসিদ্ধ বিষয়। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১০/২১০)
৫. অধিক পরিমাণ দোয়া: রমজানে উম্মাহাতুল মুমিনিনরা আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণ দোয়া করতেন। কেননা নবীজি (সা.) রমজানে দোয়া করার প্রতি উৎসাহিত করে বলেছেন, ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি জানতে পারি লাইলাতুল কদর কোনটি, তাহলে আমি সে রাতে কী বলব? তিনি বলেন—তুমি বোলো, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউয়ুন কারিমুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি। অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল দয়ালু, আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫১৩)
৬. মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্য লাভের প্রতিযোগিতা : রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীরা সব সময় তাঁর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের আকাঙ্ক্ষা রাখতেন। রমজানে তাঁদের এই আকাঙ্ক্ষা কমে যেত না, বরং তা নিয়ে স্ত্রীদের ভেতর নীরব প্রতিযোগিতা ছিল। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। আমি তাঁর জন্য তাঁবু টানিয়ে দিই। ফজরের নামাজের পর তিনি তাতে থাকতেন। হাফসা (রা.) এসে আয়েশা (রা.)-এর কাছে আরো একটি তাঁবু স্থাপনের অনুমতি চাইলেন। আয়েশা (রা.) অনুমতি দেন। এমনটি দেখে জয়নব বিনতে জাহশ (রা.)-ও একটি তাঁবু স্থাপন করলেন। ভোরবেলা রাসুল (সা.) এতগুলো তাঁবু দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সব কিছু জেনে তিনি বললেন, এগুলো দিয়ে কি তোমরা পুণ্যের আশা করছ? অতঃপর তিনি এই মাসে আর ইতিকাফ করলেন না। পরবর্তী মাস শাওয়ালে তিনি ইতিকাফ করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯২৮)
৭. নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ : ইতিকাফ অবস্থায় রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন এবং তিনিও তাঁদের সাক্ষাৎ দিতেন। হাসান বিন আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা সফিয়া বিন হুয়াই (রা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কথা বলে ফিরে যেতে উদ্যত হন। তখন রাসুলও তাঁকে এগিয়ে দিতে আসেন। উম্মে সালামার দরজার কাছে মসজিদের দরজা পৌঁছলে দুজন আনসারি রাসুলকে সালাম দেন। তখন তিনি তাদের বললেন, তোমরা চলতে থাকো। ইনি সফিয়্যাহ বিনতে হুআই (রা.)। তারা দুজন বলল, হে আল্লাহর রাসুল, সুবহানাল্লাহ। তাদের বিষয়টি অন্য রকম মনে হলো। রাসুল (সা.) বললেন, শয়তান আদম সন্তানের সঙ্গে রক্তের মতো অবস্থান করে। আমার মনে হয়েছে তোমাদের অন্তরে কোনো মন্দ কিছু এসেছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৩৫)
আল্লাহ মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের প্রতি অবিরাম শান্তি বর্ষণ করুন। আমিন।