অগ্রসর রিপোর্ট : বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, সফিউরসহ আরো কয়েকজন। বিস্ময়কর হলো, সেই ঘটনার প্রায় পাঁচ দশক পর যে দুজন ব্যক্তি একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন, তাদের নামও ছিল রফিক এবং সালাম!
কানাডাপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ৯ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের সে সময়ের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে রক্তাক্ত সংগ্রাম হয়েছে, তার বর্ণনা তুলে ধরেন। মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের এই অনন্য ঘটনাকে স্মরণ করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিতে অনুরোধ করেন রফিকুল ইসলাম। মাল্টিলিঙ্গুয়াল ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভিং গ্রুপ নামে সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি এই আবেদন করেন। এ সময় জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাকে পরামর্শ দেন বিষয়টি নিয়ে ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। একই সঙ্গে তাকে বলা হয়, ব্যক্তিপর্যায়ের অনুরোধের চেয়ে কোনো সদস্যরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেন অনুরোধটি করা হয়।
রফিকুল ইসলাম তার সঙ্গে আরেক উৎসাহী ব্যক্তি আবদুস সালামকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। সংগঠনের নাম কিছুটা বদলে রাখেন মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সাত জাতি ও সাত ভাষার ১০ জনের স্বাক্ষর নিয়ে ২৯ মার্চ ১৯৯৮ সালে তারা আবার আবেদন করেন ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের।
পাশাপাশি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের পরামর্শে রফিকুল ইসলাম যোগাযোগ করেন ইউনেসকোর সঙ্গে। প্রায় এক বছর যোগাযোগের পর ৩ মার্চ ১৯৯৯ সালে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে রফিকুল ইসলামকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ইউনেসকো জানায় তাদের কাছে বিষয়টি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। তারা কোনো সদস্যরাষ্ট্রকে দিয়ে অনুরোধ করতে পরামর্শ দেন।
এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই ইউনেসকোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনের তারিখ এগিয়ে আসছিল। রফিকুল ইসলাম এবং তার সঙ্গীরা বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশেও দায়িত্বশীলদের কাছে বিষয়টির তাৎপর্য তুলে ধরেন। সবাই মিলে ২৯টি দেশের সমর্থনের প্রাথমিক আশ্বাস পান। তখন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবের।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সাল ছিল ইউনেসকোর ৩০তম সাধারণ সভায় প্রস্তাব উপস্থাপনের শেষ দিন। রফিক, সালামসহ অন্যরা ব্যাপক চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ তখনো পৌঁছায়নি। এত অল্প সময়ে এটা আর সম্ভব না-ও হতে পারে ভেবে তারা হতাশ হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি অবহিত হন। সে সময় জাতীয় সংসদের অধিবেশনে উপস্থিত থাকা প্রধানমন্ত্রী কোনো আমলাতান্ত্রিক ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি ইউনেসকোর কাছে আবেদন পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সাল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। মূল প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। প্রস্তাবটি সমর্থন করে আইভরি কোস্ট, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, ওমান, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপিন্স, বাহামা, বেনিন, বেলারুশ, গাম্বিয়া, কমোরাস, ভানুয়াতু, মাইক্রোনেশিয়া, রুশ ফেডারেশন, লিথুয়ানিয়া, মিসর, সিরিয়া ও হন্ডুরাস। সাধারণ সভায় উপস্থিত ১৮৮ সদস্যরাষ্ট্রের সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি বাঙালিদের পাশাপাশি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মাতৃভাষার প্রিয় দিনে পরিণত হয়।