যুদ্ধাপরাধের ন্যায়বিচার বাংলাদেশে
অগ্রসর ডেস্ক : বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালকে দেশের বাইরের কেউ কেউ সমালোচনা করেছেন। তবে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তের রায়ের দিন দেশাত্মবোধক গান গেয়ে, রাস্তায় প্রস্তুতি ছাড়া সমাবেশ করে ও শিশুদের মিষ্টি বিতরণ করে রীতিমতো জাতীয় উৎসবের মতো পালিত হয়।
এই মাসের শুরুতে ট্রাইবুনাল মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৫ জনকে হত্যা এবং ৪৫০ টি বাড়ি লুট করার দায়ে ওবাইদুল হক তাদের ও আতাউর রহমান ননীকে মৃত্যুদণ্ড দিলে বাংলাদেশিরা ইতিবাচক ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।
বাংলাদেশি জনগণের জন্য এমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াটাই স্বাভাবিক।
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় দুইদিন ধরে উদযাপন করেছে। নভেম্বরে আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করার পরে একই রকম উচ্ছ্বাস ভরা সমর্থন দেখা গেছে।
জনগণের এই সমর্থন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের যুদ্ধ ও গণহত্যার সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা অভিযুক্ত যারা ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে তাদের শাস্তি দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে উৎসাহিত করেছে।
গত বছর ঢাকা ট্রিবিউনের করা দেশব্যাপী এক জরিপে দেখা যায়, ৭৯ শতাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত থাকুক বলে মত প্রকাশ করেছেন। এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম প্রধান ঘাটি খুলনা বিভাগেরও ৬৪ শতাংশ মানুষ বিচার অব্যাহত থাকার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
শুধু তাই না, ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনে জয়ের (তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ১৬ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছিলেন)প্রধান কারণ ছিল পুনরায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রতিশ্রুতি।
তাহলে বাংলাদেশের ভেতরের ও বাইরের মানুষদের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে এই মতদ্বৈধতার কারণটা কী?
কারণ, বিদেশিদের পক্ষে কখনো এটা বোঝা সম্ভব নয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার সময় এই দেশের মানুষের জীবনটা কেমন ছিল। একজন নির্যাতিত বা নিহতর সন্তান বা কন্যার চোখের সামনে দিয়ে সে হত্যাকারী বা নির্যাতকের বহাল তবিয়তে থাকার দৃশ্য কয়েক দশক ধরে দেখার যন্ত্রণাটা তারা কোনোদিনও অনুধাবন করতে পারবে না।
বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়বিচারের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ধর্ষণ ও হত্যা যুদ্ধের সময়ে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান যখন বুঝতে পেরেছিল যা তারা আর জিততে পারবে না তখন তার সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে যাদের মধ্যে ছিল চিকিৎসক, শিল্পী, শিক্ষক ও লেখকরা।
কিন্তু এই নৃশংস অপরাধের সংগঠকরা ৪০ বছর বিচারকে ফাঁকি দিতে পেরেছে। ধারাবাহিক মিলিটারি ক্যু, হত্যা, সামরিক শাসকদের ক্ষমতা অধিগ্রহণের সুযোগে যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব স্থানীয় পদ দখল করতে সক্ষম হয়।
২০০৮ নির্বাচনে সরকার গঠন করার কিছুদিনের মধ্যে শেখ হাসিনা এই অবস্থার ইতি ঘটান। তিনি তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন যা ১৯৭৫ সালে তার হত্যার পরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
রোম স্ট্যাচুট অনুযায়ী শেখ হাসিনা দুটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সর্বোচ্চ মান। প্রক্রিয়াটা ছিল স্বচ্ছ এবং উন্মুক্ত। যে কেউ বিচার দেখতে আসতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের আইসিটি হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল যেখানে বিবাদীরা একটি উচ্চতর আদালতে আপিল করার সুযোগ পায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটি সুপ্রিম কোর্ট। এবং হ্যাঁ, সুপ্রিম কোর্ট আপিলের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার নজিরও স্থাপন করেছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বস্তুনিষ্ঠ ও ন্যায়, বাংলাদেশিরা এটা জানে।
বিদেশিরা আইসিটির সমালোচনা করেছে এই বলে যে বিবাদীদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের, প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। এই দাবির দুইটা সমস্যা আছে: অন্য দলের সদস্য এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগেরও সাবেক এক সদস্যকেও ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যদি যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে তাহলে কী তারা শুধু বিরোধী দলের সদস্য বলে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে? দেখতে খারাপ দেখায় বলে ১৯৭১ সালে গণহত্যা ও যুদ্ধের শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দেবে?
এ ছাড়া জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাঠগড়ায় থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ ১৯৭১ সালে এই দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক জান্তার সঙ্গে মিলে সেটি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল।
বাংলাদেশের জনগণ অহেতুক বিতর্ক দেখলেই সেটা বুঝতে পারে। তার নিজের অভিজ্ঞতায় জানে এই যুদ্ধাপরাধীরা কী করেছিল। তারা কাছ থেকে দেখেছে কিভাবে ট্রাইবুনাল স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে। তারা ন্যায়বিচারের জন্য এই লড়াইয়ে বিশ্বাস করে। এইজন্যই এই বিচার বাংলাদেশে এত জনপ্রিয় এবং ভবিষ্যতে এটা জনপ্রিয় থাকবে।