গত এক সপ্তাহ ধরে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজন। বাদ যায়নি সেখানকার বাংলা ভাষাভাষীর পত্রিকা সম্পাদকরাও। যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই হিলারিকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে জোর প্রচারণার ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবেই আয়োজিত এক র্যালিপূর্ব সমাবেশে এ আহ্বান জানান বাংলাদেশি-আমেরিকানরা। ‘মুসলিম আমেরিকান র্যালি ফর হিলারি’ এ ব্যানারে বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসের একটি সমাবেশে অংশ নেন নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশি-আমেরিকান, মূলধারার রাজনীতিবিদসহ কমিউনিটি নেতারা। এবারের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট মুসলিম ভোটার আছেন ৩৩ লাখ। এদের সিংহভাগ আরব দেশ, পাকিস্তান আর ভারতীয় মুসলিম। বাংলাদেশিদের মধ্যে ভোটার আছেন ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ। এদের প্রায় ৯০ শতাংশ হিলারির সমর্থনে প্রকাশ্যে মাঠে কাজ করছেন। সেই কাজের অংশ হিসেবেই জ্যাকসন হাইটসে জড়ো হন বেশ কিছু মানুষ। জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজার এই আড্ডাখানার অনুষ্ঠানে রোববার যোগ দিতে নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন মুসলিম-আমেরিকান ও বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতারা। ‘মুসলিম আমেরিকান র্যালি ফর হিলারি’ এই সেøাগানকে সামনে রেখেই আগামী ৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিজয় সুনিশ্চিত করতে যে যার অবস্থান থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগসহ প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে আহ্বান জানান আয়োজকরা। এই র্যালির আয়োজকরা ছিলেন মূলত এখানকার বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী, কমিউনিটি নেতা, ডেমোক্রেট রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিচিত মুখ আর জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। কেবল নিউইয়র্ক নয়, বাংলাদেশি ও ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটিনির্ভর বিভিন্ন স্টেট থেকে জ্যাকসন হাইটসের এ সমাবেশে অংশ নেন মূলধারার রাজনৈতিকসহ নিবন্ধিত ডেমোক্রেট নেতারা। এসময়ে তারা ঘরে বসে আলোচনা না করে মাঠে সরব উপস্থিতি ও ভোটাধিকার প্রয়োগে অভিবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান। র্যালির আগে এ সমাবেশে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন হিংসা ছড়ানো প্রার্থী আখ্যা দিয়ে জাতিকে বিভক্তকারী ট্রাম্প প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হিলারির পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তারা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে হিলারিকে একজন দক্ষ ও জনবান্ধব রাজনীতিক আখ্যা দিয়ে ট্রাম্পের মতো অযোগ্য, বর্ণবাদ ও মুসিলমবিদ্বেষী প্রার্থীকে আমেরিকান উদারপন্থী জনগণ কখনোই মেনে নেবে না বলে বিশ্বাস অনেকের।
হিলারির পক্ষে সব সম্পাদক এক মঞ্চে
সব সম্পাদক এক মঞ্চে, নিউইয়র্কে হিলারির পক্ষে বাংলাদেশি আমেরিকান সাংবাদিকদের এ ছিল এক অনন্য শক্তির প্রদর্শন। একতাই যদি শক্তি হয় তাহলে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটি তার পক্ষে সে শক্তি দেখাতে পেরেছে। কমিনিটির চোখ হিসেবে কাজ করছে যে সংবাদমাধ্যমগুলো তারা সবাই একাট্টা হয়ে ঘোষণা করেছেন, আমরা এই সময়ের আমেরিকার জন্য, অভিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য, মানবাধিকারের জন্য, নারীর সম্মানের জন্য, একটি উন্নত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হিলারির পক্ষ নিয়েছি। আর তারা আহ্বান জানিয়েছেন, সব বাংলাদেশি প্রবাসীর প্রতি- আসুন আপনার ভোট দিন। কারণ ভোট দেয়ার মধ্য দিয়ে কেবল আপনার অধিকারের প্রয়োগ তা নয়, ভোট দেয়ার মধ্য দিয়েই আপনার আমাদের সবার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করা সম্ভব। আর সেই প্রার্থীটি হচ্ছেন হিলারি ক্লিনটন।
স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসের একটি কমিউনিটি সেন্টারে এই আয়োজনটি বসে। যার মূল আয়োজক ছিলেন সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক ওয়াজেদ এ খান। তিনি ডেকেছেন আর তাতে সাড়া দিয়ে এসেছেন অন্যান্য প্রধান সবগুলো সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও শীর্ষ কর্তারা। মঞ্চে ছিলেন বাংলা পত্রিকার সম্পাদক ও টাইম টিভির সিইও আবু তাহের, বাঙালি পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, পরিচয় সম্পাদক নাজমুল হাসান, বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার, আজকালের প্রধান সম্পাদক জাকারিয়া মাসুদ, ঠিকানা সম্পাদক লাভলু আনসার, প্রবাসের সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ।
আর দর্শক সারিতে ছিলেন নিউইয়র্কের অত্যন্ত গতিশীল, রাজনীতি সচেতন বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রধান মুখগুলো। ওয়াজেদ এ খান তার সূচনা বক্তৃতায় সে কথাই বলেছিলেন। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা কমিউনিটি নেতাদের কথা শোনেন। মঞ্চে থাকেন নেতারা আর সাংবাদিকরা দর্শক সারিতে অবস্থান নিয়ে তাদের কথা শুনে তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন লেখেন। কিন্তু এই আয়োজনে সাংবাদিকরা কথা বলবেন, আর দর্শক হিসেবে কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা তা শুনবেন। তারা জানবেন তাদের প্রায় সবারই এবারের নির্বাচনের পছন্দের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে কেন ভোট দেয়া উচিত। ‘সাংবাদিকের কোনো পক্ষ নেই, কিন্তু যখন অস্তিত্বের সঙ্কট সৃষ্টি হয়, যখন কেউ একটি গোষ্ঠীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তখন সেই গোষ্ঠীর সংবাদমাধ্যমকে আর নিরপেক্ষ থাকলে চলে না, সে কারণেই এই প্রকাশ্য ঘোষণার আয়োজন’ যুক্ত করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সবাই একমত, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তা হবে বাংলাদেশি তথা মুসলমানদের জন্য বড় হুমকির। তারা একমত ট্রাম্পের মতো পাগলাটে একটি মানুষের হাতে আমেরিকা তার রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারে না। পক্ষান্তরে হিলারি ক্লিনটন একজন অভিবাসীবান্ধব ব্যক্তিত্ব, তিনি জানেন, অভিবাসীরাই যুক্তরাষ্ট্রকে মহান করেছে, তারাই রেখে চলেছে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর সে কারণে হিলারির পক্ষেই দাঁড়াতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশিকে। নিউইয়র্ক থেকে এই আহ্বান জানিয়ে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের মধ্যে তা ছড?িয?ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সম্পাদকরা। তারা এও বলেছেন, সম্ভাব্য হুমকির মুখ থেকে বাংলাদেশি তথা মুসলিম কমিউনিটিকে বাঁচাতে ট্রাম্পকে ভোটের যুদ্ধে প্রতিহত করতে হবে। বাংলাদেশি সব ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেয়া, এনডোর্স করা এখানকার সংবাদপত্রে রেওয়াজ রয়েছে। হিলারির পক্ষে যেমন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে, ট্রাম্পের পক্ষেও রয়েছে। তবে একযোগে একটি কমিউনিটির সব সংবাদপত্র, সব সংবাদমাধ্যম আর সব সম্পাদক এক মঞ্চে বসে তাদের সমর্থন ঘোষণাই কেবল নয়, তাদের পাঠককুল, তথা গোটা কমিউনিটিকে উদ্বুদ্ধ করা
কী নামে ডাকা হবে?
এদিকে বিবিসি বলছে, ডেমোক্রেট প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের পুরো সময় গুগল সার্চে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন হাজারো ব্যবহারকারী। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ততই এ নিয়ে কৌতূহল প্রকট হচ্ছে। হিলারি হারলে তো সমস্যা হবে না, কিন্তু জিতলে? জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেলের স্বামী রসায়নের অধ্যাপক ইওয়াখিম সর নিজের নাম ও পরিচয়েই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একই পরিস্থিতি যুক্তরাজ্যেও। সেখানকার নতুন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে’র স্বামী ফিলিপ জন মে ফাইন্যান্সার হিসেবেই পরিচিত। জার্মানি বা যুক্তরাজ্যে অবশ্য তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের সহধর্মিণীর জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক পদবি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি এক্ষেত্রে ভিন্ন। এখানে পুরুষ প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর জন্য ‘ফার্স্ট লেডি’ পদ বিদ্যমান, কিন্তু নারী প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে? দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের নারী গভর্নরের স্বামীদের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক পদ আছে- ‘ফার্স্ট জেন্টলম্যান’। যুক্তরাষ্ট্রে এখনও ৬ জন ‘ফার্স্ট জেন্টলম্যান’ আছেন। ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে হিলারির বক্তবে?্যর সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিল’কে এ নামেই ডেকেছেন ব্যবহারকারীরা। সে সময় বিল ক্লিনটনকে ‘ফার্স্ট জেন্টলম্যান’ লিখে হ্যাশট্যাগের পরিমাণ ভাইরাল হয়ে পড়েছিল বলে গুগল জানিয়েছে। ওই একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই ৪২তম প্রেসিডেন্টের পরবর্তী পদ নিয়ে জিজ্ঞাসার পরিমাণও ছিল সবচেয়ে বেশি। সমস্যা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডিকে ‘ফ্লোটাস’ (ফার্স্ট লেডি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস) শব্দে যতটা শ্রুতিমধুর শোনায় ফার্স্ট জেন্টলম্যান অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটসের সংক্ষিপ্তরূপ অতটা শ্রুতিমধুর নয়। এজন্য অনেকে হিলারি জিতলে বিলকে ‘ফার্স্ট ডুড’ ডাকার সুপারিশ করেছেন। সেল্টিক ঐতিহ্যের কারণে কেউ কেউ তাকে ‘ফার্স্ট লেডডি’ ডাকারও প্রস্তাব করেছেন। ডেমোক্রেট প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হলে সাবেক প্রেসিডেন্টকে কী নামে ডাকা হবে? এ প্রশ্ন থেকে বাদ যাননি খোদ হিলারিও। তিনি বলেন, একদিন সে (বিল) বলছিল, রীতি ভেঙে আমার প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে তাতে সে সন্তুষ্ট। নারীদের কেবল প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হয়েই থাকতে হবে, এ রীতি ভাঙার জন্যও সে মুখিয়ে আছে। এখন একজন নারী প্রেসিডেন্টের স্বামীকে আপনারা কী নামে ডাকেন, আমরা বরং তা শোনার পরই বিবেচনা করতে পারব, গেল বছরের নভেম্বরে টেলিভিশনে এক লাইভ প্রশ্নোত্তর পর্বে এমনটাই বলেছিলেন হিলারি। ডেমোক্রেট এ প্রার্থীর ধারণা, বিল ক্লিনটন সাবেক প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তার পদের নামের ক্ষেত্রে এ জটিলতা আরও বাড়বে। বিলের ব্যাপারে এটা বেশ জটিলই হবে, কেননা এখনো সবাই তাকে সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবেই সম্বোধন করে। এজন্য আমাদের একটা যুৎসই কিছু ঠিক করতে হবে, বলেন হিলারি। বিল ক্লিনটনকে এ নামেই বেশি ডাকা হতে পারে বলে ধারণা করছে বিবিসিও। সেক্ষেত্রে হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে দুজনকে একসঙ্গে ডাকা হবে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস প্রেসিডেন্ট। হিলারি প্রশাসন চাইলে একে ঘুরিয়েও বলতে পারে- মিসেস অ্যান্ড মিস্টার প্রেসিডেন্ট। তবে যাকে নিয়ে এত আলোচনা সেই বিল ক্লিনটন কিন্তু বেশ নির্ভার। গেল সপ্তায় ডেমোক্রেট প্রার্থীর প্রচারসভায় সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, সে (হিলারি) জেতার পর, আমাকে লোকে কী ডাকবে তা নিয়ে আমিও মোটেই ভাবছি না। আমি হতে পারি প্রথম স্বেচ্ছাসেবক। সম্ভবত প্রেসিডেন্টের সেরা বিনামূল্যের স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার আশাই করতে পারি, বলেন বিল।