অগ্রসর রিপোর্ট : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিল্পের বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে দেশ-বিদেশে বাজার সৃষ্টির জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিল্পকে বহুমুখী করতে হবে। শিল্পোক্তাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে।’
শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দেশে প্রথমবারের মত আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী ‘জাতীয় শিল্প মেলা-২০১৯’ এর উদ্বোধনকালে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শিল্প উদ্যোক্তাদেরও এখন চিন্তা করতে হবে নতুনভাবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা কিভাবে শিল্পায়ন ঘটাতে পারি।
দেশের জনগণকে মেধাবী আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি এবং রপ্তানীর ক্ষেত্রে আমরা এই মেধাকে কাজে লাগাতে পারি।
তিনি বলেন, ‘কেবল একটা নিয়ে পড়ে থাকা নয়, আমাদের শিল্পায়ন, উৎপাদন, রপ্তানী এবং বাজারজাতকরণকে বহুমুখী করতে হবে। আমাদের রপ্তানীর বাস্কেট বাড়াতে হবে। আর সেটা বাড়াতে গেলে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার শিল্পায়ন। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
দেশে যে বিশাল তরুণ সমাজ রয়েছে তাদের সবার কর্মসংস্থান করাই এর মূল লক্ষ্য বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
এজন্য প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের বেলায় আমাদের মেয়েরা খুব দক্ষ হয়ে থাকে। তাঁদেরকে একটু সুযোগ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলে তাঁরা অনেক কিছুই ঘরে বসেই তৈরি করতে পারে।
শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল হালিম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, সংসদ সদসগণ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি কূটনিতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ, দেশী ও বিদেশী উদ্যোক্তা এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কর্মকান্ডের ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদোগে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী এই জাতীয় শিল্প মেলায় সারাদেশের বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির, হস্ত ও কারু এবং উচ্চ প্রযুক্তি খাতের প্রায় ৩শ’ প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ মেলার উদ্দেশ্য হচ্ছে- দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার, প্রসার, বিক্রয় ও বাজার সম্প্রসারণ এবং ছোট ও বড় উদ্যোক্তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন, যোগাযোগ ও সেতুবন্ধ তৈরিতে সহায়তা করা।
মেলায় মোট ৩শটি স্টল থাকবে। এসব স্টলে ১১৬ জন নারী এবং ১০৭ জন পুরুষ উদ্যোক্তা তাদের পণ্য প্রদর্শন করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের তরুণ সমাজকে ও নারী সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে এবং সেই সাথে সাথে দেশেও যেমন শিল্পায়ন করতে হবে আবার কৃষি পণ্যও থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে এমন বহু পণ্য রয়েছে যেগুলো আমরা উৎপাদন করে বাজারজাত করে শিল্পায়ন এবং কৃষিকে রক্ষার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও ঘটাতে পারি।
তৃণমূল পর্যায়ে সকল নাগরিক সুবিধা প্রদান করে প্রতিটি গ্রামকে একটি শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যেই তাঁর সরকার একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিল্পনীতি ঘোষণা করেছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রাপ্তির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ধরে রেখে দেশকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর মতই লক্ষ্য নির্ধারণ করে রাজনীতি করে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যখনই সরকার গঠন করেছি তখনই আমাদের আশু করণীয় কি, ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি এবং একটি যুগের পর আরেকটি যুগে কি কাজ করবো সেটি নির্ধারণ করেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিল্পপতিদের উদ্দেশ্যে দেশের বাজারকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আপনারা উৎপাদন করবেন, যদিও সবকিছুইতো আর রপ্তানী হবে না। নিজের দেশেও বাজার সৃষ্টি করতে হবে। আর নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি করতে হলে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি প্রয়োজন। অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। আর তাহলেই পণ্য বিক্রি হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজের দেশে যেখানে ১৬ কোটি মানুষ সেখানে তো একটি বিরাট বাজার নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়ে আছে। শুধু এই বাজারটিতে আপনাদের ধরতে হবে। কাজেই শিল্প গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকেও আপনাদের দৃষ্টি দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ব্যাংকের সুদের হার কমানোসহ ব্যাংক ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ করার জন্যও উদ্যোক্তাদের প্রতি আহবান জানান।
চামড়া ভালভাবে সংরক্ষণের জন্য আধুনিক কসাইখানা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের চামড়াজাত শিল্পের ভাল বাজার রয়েছে বহিঃবিশ্বে। কিন্তু আমাদের যেসব কসাইখানা রয়েছে সেগুলো মান্দাতার আমলের তাই আমি মনে করি, প্রতেকটি কসাইখানা আমাদের আধুনিকরূপে গড়ে তোলা উচিত। পশু জবাই যদি আমরা প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে, আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে করতে পারি, তবে, এর সবকিছুই কাজে লাগানো সম্ভব। যেটা প্রচুর পশু জবাই হলেও আমাদের কোরবানীর সময় এখনও করা যাচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের ভূমিকার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকার প্রধান বলেন, ‘যে অগ্রযাত্রা আমাদের শুরু হয়েছে এটা যেন কোনমতে ব্যাহত না হয়। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আপনারা কাজ করবেন।’
শিল্পায়ন ছাড়া একটি দেশ যেমন উঠে দাঁড়াতে পারে না তেমনি কেবল শিল্প দিয়ে কারো পেট ভরে না। এ সময় কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার ওপরও প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বারোপ করেন।
শিল্প মেলার আয়োজন করায় মানুষের শিল্পের প্রতি একটি আকর্ষণ সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে তিনি শিল্প রপ্তানীর ক্ষেত্রে বিমানের কার্গো সার্ভিস উন্নতকরণ এবং কার্গো ভিলেজ প্রতিষ্ঠা এবং দেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ং সম্পূর্ণ, আমরা আলু উৎপাদন করতে পারছি, সবজি উৎপানে আমরা চতুর্থ স্থানে রয়েছি, খাদ্য উৎপাদনে চতুর্থ কাজেই এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানীর জন্য আমাদের আধুনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী এসময় যত্রতত্র অপরিকল্পিত শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কৃষি জমির যেন ক্ষতিসাধন করা না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ১৬ কোটি মানুষের খাবার বন্দোবস্থটাও তো আমাদের করতে হবে এবং এটা সকলকে খেয়াল করতে হবে।
তিনি চলতি অর্থ বছরের শেষ নাগাদ প্রবৃদ্ধি ৮ দমমিক ১৩ ভাগ এবং মাথাপিছু আয় ১৯শ ৯ ডলারে উন্নীত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘অনেক ঝড়-ঝঞ্জা এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে উপেক্ষা করেও বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি।’