বগুড়া প্রতিনিধি : বগুড়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজান থেকে আসা ঢলে যুমনা নদীতে পানি আরও বেড়েছে। যমুনা নদীর পানি বেড়ে বুধবার (১২ জুলাই) দুপুরে বিপদ সীমার ৫৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত ২৪ ঘন্টায় যমুনার পানি বেড়েছে ২০ সেন্টিমিটার। এছাড়া বাঙালী নদীর পানি বিপদসীমার নীচে থাকলেও পানি বাড়ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার্তদের দুর্ভোগ বাড়ছে। পাশাপাশি নতুন করে শঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩ উপজেলার ৭৫টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। এদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে বগুড়ায় ৮০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
সরেজমিনে সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর, ধুনট উপজেলার শিমুলবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের চারপাশে পানি থৈ থৈ করছে। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসছে না। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে নিরাপদ স্থানে। কোন কোন স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবার কোনটা খোলা থাকলেও শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে আসলেও শিক্ষার্থীরা বন্যার কারণে আসতে পারছে না।
দেখা গেছে, চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা, কুতুবপুর, ধুনটের গোসাইবাড়ী, ভান্ডারবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে যারা পড়ালেখা করে তারাও যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না।
কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয় ভবনের নিচতলায় বন্যার্তরা আশ্রয় নিয়েছে। উপরতলায় ক্লাস হচ্ছে। বন্যার পানিতে ভিজে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসছে।
বগুড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানায়, জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনা তীরবর্তী ১৪টি ইউনিয়নের ১৩ হাজারেরও বেশি পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবার। যমুনায় পানি বাড়ার কারণে বাঁধ সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ও চর এলাকার নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্ব পাশের এলাকাগুলো সবচেয়ে বন্যা কবলিত হচ্ছে। বন্যার্ত লোকজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিনই বাঁধে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তদের সংখ্যা বাড়ছে। বাঁধে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোকে তাদের গবাদি পশু নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করতে দেখা গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার পানির সংকট।
এদিকে ৩টি উপজেলার ৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করার কারণে তা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সারিয়াবান্দি উপজেলাতেই প্রাথমিক মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ৬৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যা কবলিত উপজেলা ৩টির পাট, ধান, সবজী ও বীজতলাসহ ৩ হাজার ৩শ ৪০ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩০ হেক্টর জমির পাট, ১ হাজার ২শ ৫০ হেক্টর জমির আউশ ধান, ৩৫ হেক্টর জমির সবজি এবং ২৫ হেক্টর জমির বীজতলা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যার্তদের জন্য এ পর্যন্ত ২শ ৫০ মেট্রিক টন চাল ও ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া আব্দুল আলীম ও নব্বেস আলী জানান, বাড়ি-ঘরে পানি উঠায় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে আমাদের উপার্জন নেই। আমারা এখন কী খায়ে বেঁচে থাকি। গত এক সপ্তাহে ৩ কেজি চাল পাইছি। এ চাল দিয়ে কীভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনপাত করি। বড় কষ্টে কখনো অর্ধাহারে আবার কখনো অনাহারে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে।
বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হোসেন আলী জানান, সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার ৭০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। বন্যার কারণে ৫৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা উপস্থিত থাকলেও শিক্ষার্থীরা আসছে না। যে সব বিদ্যালয়ে বন্যার কারণে পড়ালেখা বিঘ্নিত হবে সে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি চলে যাবার পর অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে তা পুরণ করা হবে।
বগুড়া জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোপাল চন্দ্র জানান, সোনাতলা, সারিয়কান্দি ও ধুনট উপজেলার ৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ও দুটি মাদরাসায় বন্যার পানি উঠেছে। বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সারিয়াকান্দির নিজাম উদ্দিন উচ্চ্ বিদ্যালয়, শোনপঁচা চরের উচ্চ বিদ্যালয়, আচারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিদ্যালয় রয়েছে। ধুনটের বৈশাখী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ আরেকটি স্কুলের পরীক্ষা বন্যার পূর্বেই নেওয়া হয়েছে। বাকীগুলোতে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত বন্যার কারণে যদি ওই সব বিদ্যালয়ে পরীক্ষা ব্যাহত হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে নেওয়ার ব্যাবস্থা করা হবে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকী জানান, গরীব শিক্ষার্থী যারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ এবং বন্যার কারণে তাদের বাবা-মা পড়ালেখার সামগ্রী যোগান দিতে পারছে না, তাদের বিষয়টি দেখবো। ওই সব শিক্ষার্থীদেরও ত্রাণ ও পুনর্বাসনের আওতায় কিভাবে নিয়ে আসা যায় তা দেখছি।
যমুনা নদীর পানি রিডার জাবেদুর রহমান জানান, যমুনা নদীর পানি বুধবার সকালে বিপদ সীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা মঙ্গলবার সকালে ১৭.০৮ সেন্টিমিটার রের্কড করা হয়েছিল।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধিতে জেলার ৩টি উপজেলার কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার কিছু মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৯০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ আড়াই লাখ টাকা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।