বৃত্বা রায় দীপা
১৯৯৩ সালের শেষ নাগাদ ঢাকায় স্থিতু হলাম। আমাদের দু’ভাইবোনের বাসা তখন ধানমণ্ডি ১৯ নাম্বারে ‘ঠাঁই’ নামের বাড়িটিতে। জানা ছিল প্রিয় গায়ক সাদী মহম্মদ তাজমহল রোডে থাকেন। খুব ইচ্ছে তাঁকে একবার সামনাসামনি দেখার। আমাদের পারিবারিক বন্ধু বিপি কাকু একদিন নিয়ে গেলেন সাদী মহম্মদের বাড়িতে। বিপি কাকু সম্পর্কে সাদী মহম্মদের কাজিন। সাদী ভাই দেখা হওয়া ও আলাপের পর মূহুর্তে যেন পরম আত্মীয় হয়ে উঠলেন। মনে হচ্ছিল যেন কত যুগের চেনা! মুগ্ধ হলাম। বলাই বাহুল্য আপ্লুত হলাম! সাদী ভাই আমাকে দীপু বলে ডাকতে শুরু করলেন।
বাপী সাদী ভাইয়ের দরাজ কন্ঠের খুব সমঝদার ছিলেন। এটা জানার পর সাদী ভাই খুব চাইলেন বাপীকে সামনে বসে গান শোনাবেন আর বাপীর কাছে তাঁর সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনবেন। তো বাপী ঢাকায় এলে তাঁকে জানালাম। সন্ধ্যে নাগাদ সাদী ভাই এলেন আমাদের বাসায়। গান গল্প চললো রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। আমাদের বাড়িওয়ালা প্রচন্ড রাশভারি খালাম্মাও গান শুনতে এলেন এবং ওনার প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে সেদিন রাত বারোটা পর্যন্ত গেট খোলা রাখলেন।
এরপর থেকে নিয়ম হয়ে গেল বাপী এলে সাদী ভাই আসবেনই। একবার বাপী ঢাকায় এসেছে। আমি অফিস শেষে বাপীকে নিয়ে পার্টি অফিসে গেছি। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আট বেজে গেছে। বাসায় ফিরে দেখি সাদী ভাই ড্রয়িং রুমের খাটে বসে আছেন, তাঁর হাতে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু! আর সারা বাড়িতে শুটকি মাছের বিকট গন্ধ! জানা গেল প্রায় দেড় ঘন্টা আগে এসেছেন। কাজের মেয়েকে পাঠিয়ে মোড়ের দোকান থেকে শুটকি মাছ আনিয়েছেন। ডজন খানের কাঁচামরিচ আর প্রচুর মরিচ গুঁড়ো সহযোগে তা রান্না হয়েছে। খুব পছন্দ করতেন শুটকি মাছের ভুনা। আমাদের দু’ভাইবোনের নতুন সংসারে প্রচুর আরশোলার উৎপাত ছিল। কোনভাবেই তা তাড়ানো যাচ্ছিল না। সাদী ভাইয়ের আরশোলায় খুব ভয় ছিল তাই ঝাঁটা হাতে বসে আছেন যাতে ওরা কাছে ঘেঁষতে না পারে! আর খালি গলায় গান শোনাবেন না বলে নিজের হারমোনিয়ামটাও টেনে এনেছেন। এমন ভালোবাসতেন বাপীকে।
১৯৯৫ এর জুনে আমার বিয়ে। সাদী ভাইকে নিজের হাতে কার্ড দিতে গেলাম। ভরদুপুরে রিক্সায় যেতে ঘেমে অস্থির হয়ে গেছি। সাদী ভাই তাঁর ঘরে নিয়ে বসালেন। অপূর্ব সুন্দর করে গুছানো তাঁর ঘর। একটা মাটির ভাঁড় থেকে ঘোলের শরবত ঢেলে খেতে দিলেন। আর হাসতে হাসতে বললেন, কাউকে আবার বলিসনা আমি তোকে ঘোল খাইয়েছি! বিয়েতে যাবেন কথা দিলেন। তাঁর একটাই আবদার, তাঁকে একটা এসি রুমে থাকতে দিতে হবে। আমি বললাম, তোমার এটুকু চাওয়া তোমার কাকা নিশ্চয়ই পূরণ করবেন। সব ঠিক ছিল কিন্তু আগের রাতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষ অব্দি যেতে পারেননি। ফোন করে আশির্বাদ করেছিলেন।
রবিরাগের শুরুর দিকের অনুষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত যেতাম। অনুষ্ঠান শুরুর আগে দেখা করতাম। একটা করে বেলি ফুলের মালা প্রতিবার আমার প্রাপ্য ছিল। পরে ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়ে, বাড়ে সংসার, বাড়ে কর্তব্য। দেখা হওয়া কমতে কমতে প্রায় না ই হয়ে যায়!
গতকাল প্রথম জানালো অঞ্জন। হায়রে কষ্ট! হতবাক করা কষ্ট! শেষ পর্যন্ত আত্মহনন!!!! কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল ডিপ্রেশনের মাত্রা!!! কোন পর্যায়ে পৌঁছলে সত্তরোর্ধ একজন জীবনবাদী মানুষ আত্মহননের পথে যায়!!!
সারারাত ঘুমাতে পারিনি। কেবলই সেলুলয়েডের মতো ভাসছিস স্মৃতি। কেবলই মনে হচ্ছিলো, যে মানুষটার নিজের ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকার কথা সে মানুষটা এখন মর্গের প্রবল শীতলে ক্রমশ:হিমায়িত হচ্ছে! মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো সাদী ভাই!!!!
কীকরে মানবো এই বিস্ময়কর প্রস্থান??? পরকালে আস্থা নেই। সাদী ভাই, মানুষের হৃদয়ে তুমি বেঁচে থেকো চিরকাল!
সূত্রঃ বৃত্বা রায় দীপার facebook থেকে সংগ্রহীত