যুক্তরাজ্যের প্রিন্সেস অব ওয়েলস এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পর ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে শুরু করেছেন। তার পেটের অস্ত্রোপচারের পর রোগটি ধরা পড়ে।
তার ক্যান্সারের বিশদ বিবরণ প্রকাশ না করা হলেও কেনসিংটন প্যালেস থেকে জানানো হয়েছে, প্রিন্সেস সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে তাদের পরিপূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।
৪২ বছর বয়সী ক্যাথরিন জানিয়েছেন, প্রিন্স অব ওয়েলস উইলিয়াম এবং তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন তাদের পরিবারের কম বয়সী সদস্যদের জন্য ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে পুরো বিষয়টি নিজেদের মতো করে ব্যবস্থাপনা করার।
নিজ সন্তানদের প্রসঙ্গে তিনি জানান “জর্জ, শার্লট এবং লুইকে তাদের জন্য উপযুক্ত করে সবকিছু ব্যাখ্যা করে আশ্বস্ত করতে এবং আমি সুস্থ হয়ে উঠবো সেটা বোঝাতে সময় লেগেছে।”
এখন তার পরিবারের নিজেদের মতো করে কিছু সময় কাটানো এবং প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
ক্যাথরিন যে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, সেখানে বলেছেন যে জানুয়ারিতে যখন তার পেটে অস্ত্রোপচার হয়েছিল, তখন জানা যায়নি যে কোনও ক্যান্সার ছিল।
“তবে অপারেশনের পর পরীক্ষায় ক্যান্সার পাওয়া গেছে। তাই আমার মেডিকেল টিম পরামর্শ দিয়েছে যে আমাকে প্রতিরোধমূলক কেমোথেরাপি নিতে হবে এবং আমি এখন সেই চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায়ে আছি,” জানান ক্যাথরিন।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফেব্রুয়ারির শেষদিকে তিনি কেমোথেরাপি শুরু করেছেন।
প্যালেস থেকে বলা হয়েছে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য তারা জানাবে না, ফলে ক্যন্সারের ধরন সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু জানা যায়নি।
“প্রতিরোধমূলক কেমোথেরাপি সাধারণত অস্ত্রোপচারের পর দেওয়া হয় যাতে ভবিষ্যতে ক্যান্সার ফিরে আসার ঝুঁকি কমে” বলছিলেন কনসালট্যান্ট কোলোরেক্টাল সার্জন প্রফেসর অ্যান্ড্রু বেগস।
ডাক্তাররা ক্যান্সার কীভাবে খুঁজে পেলেন?
জানুয়ারিতে অস্ত্রোপচারের পর কেনসিংটন প্যালেস সফল অস্ত্রপচার হয়েছে বলে উল্লেখ করে। এরপর চিকিৎসকরা আরও টেস্ট করলে ক্যান্সারের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।
সাধারণত অস্ত্রোপচারের সময়ে কিছু টিস্যু আলাদা করে নিয়ে ল্যাবে পাঠানো হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশ্লেষণ করার জন্য যে সেখানে কী ধরনের কোষ রয়েছে।
শুক্রবারের ঘোষণার আগে রাজা এবং রানিকে প্রিন্সেসের খবরটি জানানো হয়।
রাজা চার্লসেরও ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে।
তিনি এবং ক্যাথরিন একই সময়ে লন্ডন ক্লিনিক প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ক্যাথরিনের পেটে অপারেশন করা হয় এবং এবং রাজা তার প্রোস্টেটের চিকিৎসা করাতে ভর্তি হয়েছিলেন।
বাকিংহাম প্যালেসের একজন মুখপাত্র জানাচ্ছেন যে “ক্যাথরিন যেভাবে সাহসের সাথে কথা বলেছেন” তাতে রাজা খুবই গর্বিত।
এক সাথে হাসপাতালে থাকার পরে, তিনি “গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার প্রিয় পুত্রবধূর সাথে খুবই কাছ থেকে যোগাযোগ রেখেছেন”।
কেনসিংটন প্যালেস থেকে বলা হচ্ছে ২৭শে ফেব্রুয়ারিতে একটি মেমোরিয়াল সার্ভিসে প্রিন্স উইলিয়ামের না থাকার কারণ ছিল এই ক্যান্সার ধরা পড়ার খবর।
বড়দিনের পর থেকে তিনি কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। এবারের ভিডিও বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “উইলিয়াম আমার পাশে থাকাটাও সান্ত্বনা এবং আশ্বাসের একটা বিরাট উৎস।”
আসন্ন ইস্টার সানডেতে রাজপরিবারের সাথে ক্যাথরিন এবং প্রিন্স উইলিয়াম থাকবেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কোনও সরকারি দায়িত্বেও শীঘ্রই ক্যাথরিনকে দেখা যাবে না।
প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন: “আমরা কেট এবং পরিবারের সুস্বাস্থ্য এবং নিরাময় কামনা করি। আশা করি তারা ব্যক্তিগতভাবে এবং শান্তিতে তা সম্পন্ন করতে পারবেন।”
ক্যান্সারের খবর নিঃসন্দেহে যে কারও জন্য উদ্বেগের। এমন অবস্থায় কেউ হয়তো জনসাধারণের জন্য ভিডিও রেকর্ড করার মতো মন-মানসিকতায় থাকবেন না। তবে এবার দেখা গেল একজন প্রিন্সেসকে সরাসরি ক্যামেরার দিকে লক্ষ্য করে এমন কঠিন বাস্তবতা নিয়ে কথা বলতে যেটা জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হবে।
ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের অনুষ্ঠানে ক্যাথরিনের না থাকা এবং জানুয়ারিতে অস্ত্রোপচারের পর থেকেই এই দম্পতি ছিলেন নানা আলোচনায়।
কেটের স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও চলছিল বিতর্ক। সেটা আরও বেড়ে যায় মার্চের শুরুর দিকে মা দিবসে সন্তানদের সাথে একটি ছবি প্রকাশ করার পর যেটি এডিট সংক্রান্ত অসঙ্গতির কারণে পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমগুলো তুলে নেয়।
এজন্য অবশ্য কেনসিংটন প্যালেসের একটি বার্তার মধ্য দিয়ে নিজের আনাড়ি এডিটের বিষয়ে ক্ষমা চান ক্যাথরিন।
সেসব ঘটনাপ্রবাহের সাথে রাজকীয় কৌশল সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসির কালচারাল ও মিডিয়া এডিটর কেটি রাজ্জাল।
সপ্তাহখানেক ধরে আলোচনা হচ্ছিল এ কেনসিংটন প্যালেসের জনসংযোগের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।
মা দিবসে পোস্ট করা ছবির উদ্দেশ্য বিতর্ক বা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব দমন হলেও ঘটে উল্টোটা। যদিও ছবিটি যেএডিট করা বা পরিবর্তন করা হয়েছে, প্রকাশের আগে সেটা কেনসিংটন প্যালেসের পিআর (পাবলিক রিলেশনস) বা জনসংযোগ টিম জানতো কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তবে এবারের আবেগভরা ভিডিওটি যেন সবকিছু পাল্টে দেয়ার মতো।
প্রাসাদের ভেতরের মানুষজন এটা স্পষ্ট করতে আগ্রহী যে, এ পরিকল্পনা তাদের আগে থেকেই ছিল যে – রাজা যেমন তার ক্যান্সারের কথা জাতিকে জানিয়েছিলেন, প্রিন্সেসের মনেও ছিল যে তিনিও এটা জানাবেন। সেজন্য এমন একটা সময় বেছে নেয়া হয় যে সময় বাচ্চাদের স্কুল ছুটিতে থাকবে।
তবে অনেকের মনে একরকম একটা ভাবনা বা ক্ষোভও কাজ করছে যে প্রিন্সেসকে বুলিং করা হয়েছে, যার ব্যাখ্যা হচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের চাপে পড়ে তাকে স্বাভাবিক বিবৃতির বাইরে গিয়ে ভিডিওতে আসতে একরকম বাধ্য করা হয়েছে।
ডাউনিং স্ট্রিটের গণযোগাযোগের প্রাক্তন পরিচালক স্যার ক্রেগ অলিভার বলেছিলেন: “প্রিন্সেস অফ ওয়েলসের বার্তার আরেকটি অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে কাউকে কষ্ট দেয়ার মতো জল্পনা-কল্পনা করার আগে দয়া করে চিন্তা করুন।”
ক্যাথরিনের গোপনীয়তার অধিকার এর আগেই স্পষ্ট করেছিল কেনসিংটন প্যালেস। প্রিন্সেস লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় দ্রুতগতিতে গুজব যেসব ছড়াচ্ছিল তা নিশ্চয়ই তাদের জন্য ভীতিকর ছিল।
চিকিৎসার মাঝে আমেরিকান টেলিভিশনে তার বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় অনলাইনে জল্পনা কল্পনা যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল।
ক্যাথরিনের ভিডিও দেখে খানিকটা ভিন্নভাবে দ্বিতীয় এলিজাবেথের কথা মনে পড়ে যায় যখন প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর পর তিনি টেলিভিশনের সামনে আসেন।
প্রয়াত রানির অনুপস্থিতি ও সমালোচনার প্রেক্ষিতে তিনি জনসমক্ষে আসতে একরকম বাধ্য হয়েছিলেন। তাকে দাদী হিসেবে একরকম ও রানি হিসেবে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল।
কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনা হয়েছে যে রাজপ্রাসাদ তাদের তথ্য জানানোর ধারাবাহিকতা হারিয়েছে, রাজকীয় ব্র্যান্ড একটি ধাক্কা খেয়েছে।
নিশ্চয়ই জাতির এবং পরিবারের চাহিদার সাথে তাল মেলানো বেশ কঠিন। তবে ক্যাথরিনের ভিডিও থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, কেন এতদিন তাকে প্রকাশ্যেদেখা যায়নি।
রাজপ্রাসাদের জনসংযোগ কিভাবে কাজ করে যারা তা জানেন, তাদের দৃষ্টিতে ক্যাথরিনের ভিডিও এবং এর সাথে জনসংযোগ প্রশংসার দাবিদার।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রাক্তন প্রেস সেক্রেটারি চার্লস অ্যানসন বিবিসিকে বলছিলেন, “ইন্টারনেট যুগে ঠিকমতো ক্রমানুযায়ী সঠিক তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন কাজ”। কিন্তু প্রিন্সেসের ভিডিওটি “পরিবারের জন্য একরকম সুরক্ষা তৈরি করার পাশাপাশি জনসাধারণকে জানানোর জন্যও একদম সঠিক ছিল”।
এতে কোনও সন্দেহ নেই যে গত কয়েক মাসে সামাজিক মাধ্যম ও কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেভাবে ভয়ঙ্কর এবং নির্দয় হয়েছে সেটা তাদের জন্য ধাক্কা ছিল। প্যালেসের জনসংযোগ সম্পর্কে ধারণা থাকা বেশ কয়েকজন বলেছেন এ পর্যন্ত এটি সবচেয়ে খারাপ ধরনের একটি উদাহরণ।
যেমনটা জনসংযোগের গুরু মার্ক বোরকোস্কি বলেছেন যে রাজপরিবারের জন্য যোগাযোগ হল “বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন কাজ… আপনার ভালো সময় থাকবে এবং খারাপ সময়ও থাকবে,” তবে প্রিন্সেসের বার্তা আপাতত সব থামিয়ে দিয়েছে।
“তারা নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিতে পেরেছে।” প্রিন্সেস অফ ওয়েলসের ভিডিও যুক্তরাজ্য ও এর বাইরেও অনেক বেশি ভালোবাসা ও সহানুভূতির সঞ্চার করেছে।