স্টাফ রিপোর্টার: পড়াশোনায় ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ, ক্লাসে প্রথম ছাড়া কোনোদিন দ্বিতীয় হয়নি সাবিহা আক্তার সোনালী (১৪)। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সাবিহার পড়ালেখার খরচ চালাতে যেন পরিবারের অসুবিধা কম হয় সেজন্য নিজেই তেজগাঁও সরকারি গার্লস স্কুলে ভর্তির উদ্যোগ নেয়।
জেএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া সাবিহার স্বপ্ন ছিল চিকিৎক হয়ে মানুষের সেবা করবে। তারই একধাপ এগিয়ে নিতে তেজগাঁও সরকারি গার্লস স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ফাইলে নিজের সকল কাগজপত্র নিয়ে রওনা দিয়েছিল ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ফাইলবন্দিই রয়ে গেল। কারণ, রাজধানীর হাইকোর্টের সামনের সড়কে শনিবার সকাল ৮টার দিকে বাসচাপায় নিহত হয় সাবিহা। রক্তাক্ত দেহ; মাথার মগজও বের হয়ে গিয়েছে তবু মৃত্যুর সময়ও সে তার হাতের ফাইলটি ধরে রেখেছিল। ফাইলটির ভেতর সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে নতুন স্কুলে ভর্তির ফি ছিল। ট্রান্সপারেন্ট ফাইলটির মধ্য দিয়ে সেগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
সাবিহার মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। ফারজানা, কবিতা, আফসানা আক্তার বিথীসহ বেশ কয়েকজন সহপাঠী ঢামেক মর্গে আসে। তারা দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, সেগুনবাগিচার রহিমা বেগম আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সাবিহা জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেধাবী সাবিহা সব সময় ক্লাসে প্রথম হতো। সে যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিত। তার গানের গলা ছিল অসাধারণ। প্রধানমন্ত্রীর কোনো অনুষ্ঠান হলে গান গাইত। ‘ক্ষুদে গানরাজ’ প্রতিযোগিতায়ও সে অংশ নিয়েছিল। খেলাধুলাতেও ছিল পারদর্শী।
সাবিহাকে তার বাবা আদর করে ডাকতেন সোনালী। ভর্তির পর বিকেলে নতুন স্কুলের পোশাক কিনতে যাওয়ার কথা ছিল। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন সাবিহার বাবা-মা। মেয়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।
পিরোজপুরের নাজিরপুর থানার ঝনঝনিয়া গ্রামের বাসিন্দা সাবিহার বাবা জাকির হোসেন দ্য রিপোর্টকে জানান, গণপূর্ত অধিদফতর কলোনি এলাকায় ভাড়া থেকে রং মিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। রাজধানীর গণপূর্ত অধিদফতর কলোনির বাসা থেকে নতুন স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে সকালে বের হয় সে। হাইকোর্টের সামনের রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগতির যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী রুটের (৮ নম্বর পরিবহন) একটি বাস (ঢাকা মেট্রো জ ১১-১৩২৮) তাকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।
তিনি আরও জানান, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে আমার সংসার ছিল। ছেলে সাজ্জাদ হোসেন সৈকত নরসিংদী পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করছে। রং মিস্ত্রির কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকার মতো আয় হয়। ওদের মা শারমিন আক্তার কুলসুম ‘প্রভাভী বনশ্রী’ পরিবহনের অফিসে পিয়ন হিসেবে কর্মরত। ৭ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেওয়ার পর বাকি টাকা সংসার খরচেই যায়। ওদের দু’জনের পড়ালেখার খরচ কিছুটা কম করানোর জন্য ছেলে নরসিংদীতে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয় এবং মেয়ে তেজগাঁও সরকারি গার্লস স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
দুর্ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত সার্জেন্ট আমজাদ দ্য রিপোর্টকে জানান, ঘাতক বাসটি জব্দ করা হয়েছে। তবে চালক পালিয়ে গেছে।
এ ঘটনার সাত ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি শাহবাগ মোড়ে শনিবার বিকেলে একটি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় খাদিজা সুলতানা মিতু (১২) নামের এক স্কুল ছাত্রী মারা যায়। খাদিজা লক্ষণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এরপর লক্ষণপুর ফাজিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ঢাকায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল।
দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে খাদিজা সবার ছোট। খাদিজা আক্তারের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার মনোহরগঞ্জে। তার বাবা বাচ্চু মিয়া আবুধাবীতে প্রবাসী এবং মা রোকেয়া বেগম গৃহিণী।
বড় বোন আয়েশা সিদ্দিকা শিমু বিলাপ করতে করতে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমার হাত ধরেই ও রাস্তা পার হচ্ছিল। ওকে না নিয়ে আল্লাহ আমাকে কেন নিয়ে গেল না।’
তিনি জানান, পরিবার নিয়ে তারা রাজধানীর শ্যামপুরে থাকেন। ১০-১২ দিন আগে গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন। শনিবার সকালে স্বামী ওমর ফারুক, ছেলে ইশতিয়াক বিন ওমর ও ছোট বোন খাদিজাকে নিয়ে শাহবাগের শিশুপার্কে ঘুরতে আসেন। ঘুরতে এসে তার সব আবদার পূরণ করা হয়। শিশুপার্কে ঘোরা শেষ হলে দুপুরের খাবার খেতে শাহবাগের দিকে যেতে রাস্তা পার হওয়ার সময় যাত্রীবাহী বাস খাদিজাকে চাপা দেয়।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক দ্য রিপোর্টকে জানান, ঘটনার পর ওই বাস জব্দ ও চালককে আটক করা হয়েছে। লাশ ঢামেক মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।