অগ্রসর রিপোর্ট: চারদিন আগে মাকে হারিয়েছেন। এবার নিজেই চিরবিদায় নিলেন ইরফান খান। ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় এই অভিনেতা আর নেই। আজ বুধবার মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধিরুবাই আম্বানি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর।
কোলন সংক্রমণের কারণে হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল ইরফানকে। তার মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে আছেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তার পাশে ছিলেন স্ত্রী সুতপা সিকদার ও দুই ছেলে বাবিল ও আয়ান খান।
২০১৮ সালের মে মাসে নিওরোএন্ডোক্রাইন টিউমার নামের বিরল ক্যানসারে আক্রান্ত হন ইরফান খান। উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেকটা সময় যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ছিলেন তিনি।
ইরফানের মৃত্যুর পর তার পরিবার আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমি আত্মসমর্পণ করেছি’—২০১৮ সালে ক্যানসারের সঙ্গে লড়ার প্রসঙ্গে এমন কিছু শব্দে নিজের অভিব্যক্তি জানিয়েছিলেন ইরফান। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী মানুষ। গভীর চোখ ও স্মরণীয় গুণের মাধ্যমে নীরব অভিব্যক্তিতে অভিনয় করতেন পর্দায়। দুঃখের সঙ্গে আজ (২৯ এপ্রিল) তার মৃত্যুর সংবাদ জানাতে হচ্ছে। ইরফান শক্ত মনের মানুষ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন তিনি। তার কাছে আসা প্রত্যেককে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছেন। ২০১৮ সালে বিরল ক্যানসারের কথা জেনে বজ্রপাতের আঘাতের মতো লেগেছিল তার। তবে দমে যাননি। এরপর জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রচুর লড়াই করেছেন। পরিবারকে নিয়ে সবচেয়ে যত্নবান ছিলেন তিনি। হাসপাতালে তারা চারপাশে ছিল। তাদের রেখে স্বর্গের পথে যাত্রা করেছেন তিনি। নিজের ভালো কিছু কর্ম রেখে গেছেন। আমরা সবাই তার শান্তি কামনা করি এবং আশা করি তিনি শান্তিতে আছেন। আজ তিনি বেঁচে থাকলে বলতেন, ‘আমি যেন প্রথমবারের মতো জীবনের জাদুময় অংশের স্বাদ নিচ্ছি।’
অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই নিয়ে কিছুদিন আগে আবেগঘন কথা লিখেছিলেন ইরফান, ‘আমার বাজি ছিল অন্যরকম। দ্রুতগতির একটি ট্রেনে ঘুরছিলাম। স্বপ্ন, পরিকল্পনা, আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য ছিল। এগুলোকে ঘিরে খুব ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ কেউ আমার কাঁধে টোকা দিলো এবং আমি পিছু ফিরে তাকালাম। তিনি টিকিট কালেক্টর। আমাকে জানালেন, ‘আপনার গন্তব্য চলে এসেছে। অনুগ্রহ করে নামুন।’ আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললাম, ‘না, না। আমার গন্তব্য আসেনি।’ টিকিট কালেক্টর বললেন, ‘না, এটাই আপনার গন্তব্য। কখনও কখনও এমন হয়।’
গত ২৫ এপ্রিল ইরফানের মা সাইদা বেগম রাজস্থানে মারা যান। সারাভারতে আরোপিত অবরোধের (লকডাউন) কারণে তাকে সামনে থেকে শেষবারের মতো দেখা হয়নি তার। ভিডিও কলের মাধ্যমে মাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান তিনি। মায়ের যাওয়ার চারদিন পর ছেলেও চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা সুজিত সরকার শোক প্রকাশ করেছেন টুইটারে। বুধবার দুপুর ১২টা ৬ মিনিটে তিনি লিখেছেন, ‘আমার প্রিয় বন্ধু ইরফান, তুমি দিনের পর দিন লড়েছো। তোমাকে নিয়ে সবসময় গর্ব হবে আমার। আবারও আমাদের দেখা হবে। সুতপা ও বাবিলের জন্য সমবেদনা। তোমরাও লড়েছো। সুতপা তুমি এই লড়াইয়ে যথাসাধ্য সব করেছো। শান্তিতে থাকো। ইরফান খান স্যালুট।’
এ বছর ‘অ্যাংরেজি মিডিয়াম’ ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় ফিরেছিলেন ইরফান। তবে এর প্রচারণা করতে পারেননি তিনি। এটি তারই অভিনীত অভাবনীয় ব্যবসাসফল ছবি ‘হিন্দি মিডিয়াম’-এর (২০১৭) সিক্যুয়েল।
লকডাউন ঘোষণার আগে মুক্তি পাওয়া ‘অ্যাংরেজি মিডিয়াম’-এ মেয়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যাওয়া একজন অবুঝ বাবার চরিত্রে ইরফানের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। লকডাউনের কারণে সিনেমা হলে থেমে যায় ছবিটি। এরপর এটি মুক্তি পায় অনলাইনে। হোমি আদাজানিয়ার পরিচালনায় এতে আরও অভিনয় করেছেন কারিনা কাপুর, রাধিকা মদন ও দীপক দোবরিয়াল।
১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি ভারতের রাজস্থান রাজ্যের জয়পুরের কাছে টঙ্ক গ্রামে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইরফান খান। তার মা সাইদা বেগম ছিলেন নবাব পরিবারের মেয়ে। বাবার মৃত্যুর পর তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় ইরফান যোগ দেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায়।
ইরফানের প্রতিভা প্রথম ধরতে পারেন মীরা নায়ার। তাই ১৯৮৮ সালে ‘সালাম বোম্বে’ ছবিতে তাকে নেন তিনি। এরপর তারা ২০০৭ সালে ‘দ্য নেমসেক’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেন। এছাড়া ২০০৯ সালে ১১টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির সংকলন ‘নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ’তে মীরা-ইরফান জুটিকে আরেকবার পাওয়া যায়।
আশির দশকে টেলিভিশনে নিয়মিত কাজ করতেন ইরফান খান। এরপর আসিফ কাপাডিয়ার ‘দ্য ওয়ারিয়র’-এর মাধ্যমে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। গুণী এই অভিনেতার সেরা কাজের তালিকায় অন্যতম বিশাল ভরদ্বাজের ‘মকবুল’ (২০০৩), সুজিত সরকারের ‘পিকু’ (২০১৫) ও রিতেশ বাত্রার ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ (২০১৩)। ২০১২ সালে তিগমাংশু ধুলিয়ার ‘পান সিং তোমর’ ছবিতে অনবদ্য নৈপুণ্য দেখিয়ে সেরা অভিনেতা হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
হলিউডের বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন ইরফান খান। এ তালিকায় উল্লেখযোগ্য—ড্যানি বয়েলের ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ (২০০৮), টম হ্যাঙ্কস অভিনীত ‘ইনফারনো’ (২০১৬), অ্যাঙ লি পরিচালিত ‘লাইফ অব পাই’সহ (২০১২), মারভেল স্টুডিওসের ‘দ্য অ্যামাজিং স্পাইডার-ম্যান’ (২০১২), কলিন ট্রেভরো পরিচালিত ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ (২০১৫), অ্যাঞ্জেলিনা জোলি অভিনীত ‘অ্যা মাইটি হার্ট’ (২০০৭)।
বাদ যায়নি বাংলাদেশের ছবি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় ‘ডুব’ ছবিতে দেখা গেছে তাকে। এর ইংরেজি নাম ‘নো বেড অব রোজেস’। কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ছায়া পাওয়া যায় তার জাভেদ চরিত্রে। এটি সহ-প্রযোজনা করেছিলেন তিনি।