অগ্রসর রিপোর্ট :মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। অং সান সু চিসহ ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করা হয়েছে। দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
বিবিসি জানায়, সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) প্রত্যুষে সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ অন্য নেতাদের আটক করা হয়েছে। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মুখপাত্র মিও নয়েন্ট এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের তথ্য নিশ্চিত করেছে। সেনাসদস্যরা বিভিন্ন শহরের রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের ধরে নিয়ে গেছেন।
সু চিসহ শীর্ষ নেতাদের আটকের পর সেনাবাহিনী জানায়, দেশে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকেই ক্ষমতাসীন দল এনএলডি ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এ বিষয়ে সারাক্ষণসহ বিশ্বের স্বনামধন্য অন্য গণমাধ্যমগুলোতে ইতোমধ্যেই খবর প্রকাশিত হয়েছে।
গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ভোটে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি সরকার গঠনের মতো যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ৩২২টি আসনই যথেষ্ট, সেখানে এনএলডি ৩৪৬টি আসন লাভ করে। তবে সেনাবাহিনী নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনে।
সেনা-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) কারচুপির অভিযোগ এনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানায়। তার পর থেকেই মিয়ানমারে জোরালো হয় সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা।
সোমবারই মিয়ানমারের সংসদের নিম্নকক্ষের অধিবেশন আহ্বানের কথা ছিল। তবে সেনাবাহিনী এই অধিবেশন বন্ধ করে দেয়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লেয়িংয়ের কাছে সব ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিবিসিসহ অন্য গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী রাজধানী নেপিডো, ইয়াঙ্গুনসহ অন্য শহরগুলোতে টহল দেয়া শুরু করেছে। সকাল থেকেই সেখানকার রাজপথের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারের বড় শহরগুলোতে মোবাইল টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগসহ অন্য টেলিসেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম এমআরটিভি সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে।
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন হেড বলেছেন, মিয়ানমারের সংবিধান অনুসারে সেনাবাহিনীর হাতে এমনিতেই ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া আছে, যার বলে তারা দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে। তার পরও সু চিকে গ্রেপ্তার করা প্ররোচনামূলক ও ঝুঁকিপূর্ণ, যেকোনো সময় এর পাল্টা প্রতিরোধ দেখা দিতে পারে।
১৯৮৮ সালের পর এটি মিয়ানমারে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। ২০১১ সালে সরকার গঠনের মাত্র এক দশক পর দেশটিতে বেসামরিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটল।
২৬ জানুয়ারি একটি সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র অভ্যুত্থানের আগাম প্রস্তুতির বিষয়টি নাকচ করে দিতে পারেননি। পরের দিন, সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লেইং একটি সামরিক একাডেমিতে বলেন, ‘যদি সংবিধান অনুসরণ করা না হয়, তাহলে তা অবৈধ ঘোষণা করা উচিত।’
সেনাবাহিনীর প্রধানের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতির বরাত দিয়ে মিয়ানমারের পত্রিকা ইরাবতিতে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং নির্বাচন নিয়ে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে আইন অনুসারে কাজ করবে। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, নির্বাচন নিয়ে সেনা জেনারেলদের আপত্তির মুখে আগেই অনুমান করা হয়েছিল সেখানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানালেও সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এবং ফল বাতিল করতে হবে।
রোহিঙ্গা গণহত্যায় সমর্থন দিয়ে নিন্দিত সু চি
মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সান-এর মেয়ে অং সান সু চি। সু চির বয়স যখন দুই বছর, তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করার ঠিক আগে তাকে হত্যা করা হয়।
সু চি-কে একসময় বিশ্বমানবতার মশাল হিসেবে দেখা হতো। তিনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ কর্মী, যিনি নিজের স্বাধীনতা ত্যাগ করে কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার শাসন করা সেনাবাহিনীর জেনারেলদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে আচরণে সু চির সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যায়।
১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রায় ১৫ বছর আটক থেকেছেন সু চি। ২০১৫ সালের নভেম্বরে, ২৫ বছরের মধ্যে মিয়ানমারের প্রথম প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে তিনি ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি-কে (এনএলডি) নেতৃত্ব দেন, এবং একটি দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করেন।
মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী, তার সন্তান বিদেশি নাগরিক হওয়ায়, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। তবে, বর্তমানে ৭৫ বছর বয়সী সু চি-কে ডি ফ্যাক্টো লিডার হিসেবেই দেখা হয়।
তবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে, তার নেতৃত্ব সংজ্ঞায়িত হয়েছে দেশের বেশিভাগ মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের প্রতি তার আচরণ দ্বারা।
২০১৭ সালে, রাখাইন রাজ্যের থানাসমূহে সেনা অভিযানের কারণে কমপক্ষে ১০ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে যায়।
বহির্বিশ্বে সু চির সাবেক সমর্থকরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। বলা হয়, ক্ষমতাবান সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার ঘটনাকে নিন্দা জানাতে অস্বীকার করার পাশাপাশি ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যা বন্ধ করার জন্য তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি।
২০১৯ সালে হেগ শহরে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার শুনানিতে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে সু চি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন জানালে ঘটনা নতুন মোড় নেয়, যা তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি কমানোর কারণ হিসেবে কাজ করে।
সু চি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়, রোহিঙ্গাদের প্রতি যাদের সহানুভূতি নেই বললেই চলে। রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রতি সমর্থন দিয়ে সু চি আজ বিশ্বে চরম নিন্দিত একজন রাজনীতিক। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় বিশ্বের দেশে দেশে তাকে জানানো সম্মান কেড়ে নেয়া হয়েছে।