অনলাইন ডেস্ক- গোপালগঞ্জ শহরটির আদি নাম ছিল খাটরা। এ শহরটি খাটরা মৌজায় অবস্থিত। এখানে গোপালগঞ্জ নামে ভিন্ন কোন স্থান গ্রাম বা মৌজা নেই। এ অঞ্চলটি অতীতে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ ও বিপদসংকুল। সম্ভবত সুলতানি আমলে পশ্চিমা সৈন্য সামন্তদের উত্তরাঞ্চলে যেতে হলে এ পথেই যেতে হতো। এ অঞ্চলটি বিপদসংকুল হওয়ার কারণে ফার্সি ভাষায় ওইসব সৈন্য সামন্ত খত্রা নামে অভিহিত করে এ এলাকাকে। তাদের উচ্চারিত খত্রা শব্দের অপভ্রংশই খাটরা হয়ে বৃটিশ আমলে সিএস জরিপে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে।
গোপালগঞ্জের পূর্ব নাম ছিল রাজগঞ্জ। মকিমপুর স্টেটের জমিদার রানী রাসমনীর জমিদারি এলাকা খাটরা মৌজায়। আর এই খাটরা মৌজায় ছিল রাজগঞ্জ। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় একজন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন জেলে সম্প্রদায়ের মেয়ে রাসমনি। এ মহৎ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি লাভ করেছিলেন মকিমপুর পরগনার জমিদারি। খাটরা মৌজা ছিল মকিমপুর পরগনার আওতাধীন একটি এস্টেট। রানী রাসমনী বাস করতেন কলকাতার করনেশন স্টেটে। তার হয়ে নায়েব রজনী ঘোষ আজকের গোপালগঞ্জ (তত্কালীন রাজগঞ্জ) এলাকার জমিদারি তদারকি করতেন। রানী রাসমনীর স্নেহ ভাজন নায়েব রজনী ঘোষের এক আদুরে নাতির নাম ছিল নবগোপাল। রানী প্রজাদের ইচ্ছায় নবগোপালের নামের অংশ গোপাল-এর সাথে পূর্বেকার রাজগঞ্জের নামের গঞ্জ যুক্ত করে গোপালগঞ্জ নামের প্রবর্তন করেন।
সুলতানি আমল ও মোগল আমলে জেলা ফতেহবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল এ অঞ্চল। পরে গোপালগঞ্জ ফতেহবাদের থানা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারক সেন্ট মথুরনাথ বসুর প্রচেষ্টায় গোপালগঞ্জকে মহকুমায় উন্নীত করা হয়। সেন্ট মথুরনাথ বসুই প্রথমে গোপালগঞ্জে কোর্ট এবং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে ফরিদপুর জেলার মহকুমা থেকে গোপালগঞ্জ জেলা সৃষ্টি হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গোপালগজ্ঞ এলাকা ফরিদপুর জেলায় মাদারিপুর মহকুমা ও থানাধীন ছিল। ঐ সময়ে মাদারিপুরের সাথে এ এলাকায় জলপথ ছাড়া কোন স্থল পথের সংযোগ ছিল না। কোন স্টীমার বা লঞ্চ চলাচলও ছিল না। কেবলমাত্র বাচাড়িনৌকা, পানসি নৌকা, টাবুরিয়া নৌকা, গয়না নৌকা, ইত্যাদি ছিল চলাচলের একমাত্র বাহন। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে এ এলাকায় পুলিশ প্রশাসন ছিল খুবই দুর্বল। মামলায় আসামীরা গ্রেফতারের ভয়ে দুর্গম বিল অঞ্চলে আত্বগোপন করে থাকত। এ সমস্ত অসুবিধার দরুন ১৮৭০ সালে গোপালগজ্ঞ থানা স্থাপিত হয়। ১৮৯৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কলকাতা গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এর সীমানা নির্ধারিত হয়। ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতি হতে থাকে। বর্তমানে যেখানে থানা অবস্থিত ঐ স্থানে একটি টিনের ঘরে থানা অফিসের কাজকর্ম চালু করা হয়।[১]
১৯০৯ সালে ফরিদপুর সদর মহকুমা থেকে কাশিয়ানী ও মুকসুদপুর থানা এবং মাদারিপুর থেকে গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া থানা নিয়ে গোপালগজ্ঞ মহকুমা স্থাপিত হয়। মিশন স্কুলের দক্ষিণ পার্শ্বে দেওয়ানী আদালত ও সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের স্থান নির্দিষ্ট হয়। তার দক্ষিণে মোক্তার লাইব্রেরীসহ ফৌজদারী আদালত ভবন ও সংশ্লিষ্ট অফিসের জন্য নির্ধারিত হয়। বর্তমানে যেখানে ডিসি অফিস সেখানে বিরাটকায় চারচালা গোলপাতার ঘর বাঁশের বেড়া দিয়ে ফৌজদারী কোর্ট ও সংশ্লিষ্ট অফিসের জন্য নির্মিত হয়। তার দক্ষিণে বর্তমান জেলখানার স্থানে একটি বিরাটকায় গোলের ঘর তুলে মজবুত বাঁশের বেড়া অস্থায়ী জেলখানা নির্মিত হয়। বর্তমানে যেখানে মোক্তার বার ভবন ঐ স্থানে একটি ছনের ঘরে মোক্তারগণ আইন ব্যবসা শুরু করেন। ঐ সময়ে কোন উকিল এখানে আইন ব্যবসা করতে আসেনি। গোপালগজ্ঞের প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন মি: সুরেশ চন্দ্র সেন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয়। পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান পান্না বিশ্বাস। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোপালগজ্ঞ সদর থানা উপজেলায় উন্নীত হয়। প্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন জনাব এইচ নুর মোহাম্মদ।
এ অঞ্চলের ঘর্ঘরা (বর্তমান ঘাঘর) নদীর তীরে মোগল সম্রাট বাবরের সঙ্গে বাংলার সুলতান নুশরত শাহর যুদ্ধ হয়। ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে এ অঞ্চলের সন্ন্যাসি ও ফকির বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। ৬৯ সালে গণঅভ্যুথানের সময় শহীদ হন জলিরপাড় স্কুলের ছাত্র মহানন্দ বিশ্বাস। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের সংগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর পুত্র নাসির উদ্দিন নসরত্ শাহর যুদ্ধ হয় এ অঞ্চলের ঘর্ঘরা নদীর তীরে। ঘর্ঘরা নদীই বর্তমানে কোটালীপাড়ার পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘর নদী। নসরত্ শাহর আমলে দক্ষিণাঞ্চলে পর্তুগিজদের আক্রমণ ও লুটতরাজ বৃদ্ধি পেলে গোপালগঞ্জের সাধারণ লোকজন নিয়ে তিনি তা মোকাবেলা করেন।
ব্রিটিশ আমলের শুরুতেই এ অঞ্চলে সন্ন্যাসি বিদ্রোহ ও ফকির বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। তৎকালিন মাদরিপুরের কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ সন্ন্যাসি ও ফকিরদের বেশ কিছু আখড়া ছিল। এ অঞ্চলের সবচেয়ে ঐতিহাসিক আন্দোলন হলো ফরায়েজি আন্দোলন। এখানে নীল চাষ বিরোধী আন্দোলনও হয়েছে। ১৮৪৬ সালে দুদু মিয়ার অনুচর কাদের বক্সের নেতৃত্বে পাঁচ চরে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ হয়। নীল কুঠির কর্নধার ডানলপ পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কোটালীপাড়ার বান্ধাবাড়ী গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস শহীদ হন। তিনি এ জেলার প্রথম শহীদ। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় শহীদ হন জলিরপাড় গ্রামের মহানন্দ বিশ্বাস। গোপালগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক গৌরবজ্জল ইতিহাস। ২৫ শে মার্চ হতে ২৫ দিন ছিল এ জনপদ শত্রুমুক্ত । ৩০ এপ্রিল এ জেলায় মেজর ঘোরী স্টিমার যোগে খুলনা হতে গোপালগঞ্জ এর সাথে শুরু হয়ে যায় গেরিলা প্রশিক্ষণ ও কৌশলগত রনযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিল নিয়মিত সেক্টরে কার্যক্রম । এ এলাকাটি সীমান্ত এলাকা হতে দুর হওয়ায় সেক্টর কমান্ড ছাড়া এখানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট নিজস্ব বাহিনী । গ্রামে গ্রামে সযত্নে প্রতিরোধ । এরূপ তিনটি বিশেষ বাহিনী ছিল ১। হেমায়েতবাহিনী ২। মুজিববাহিনী ৩। মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনী নেতৃত্বে ছিল বর্তমান সদর উপজেলার চেয়ারম্যান জনাব লুৎফর রহমান, মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ইসমত কাদির, হেমায়েত বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন হেমায়েত উদ্দিন বীর বীক্রম । এছাড়া সেনাবাহিনী, ইপিআর ও অন্যান্য বাহিনী হতে পালিয়ে আসা সদস্যগন তাদের গ্রামে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন । এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন হালিম, ক্যাপ্টেন মিলু, ক্যাপ্টেন সিহাবউদ্দিন, ক্যাপ্টেন জামাল,আবদুর রহমান প্রমুখ।
জেলার গুরুত্বপূর্ন সম্মূখযুদ্ধঃ-
১। ভাটিয়াপাড়ার যুদ্ধঃ মধ্য আগষ্ট মাসে কমান্ডার ইসমত কাদির ও ক্যাপ্টেন হেমায়েতের যৌথ নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস ষ্টেশনে অবস্থিত পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায় । ঐ যুদ্ধে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিল। ঐ যুদ্ধেস্থলে ১৯ জন পাক সেনা ও ৫জন রাজাকার নিহত হয়।
২। ফুকরা যুদ্ধঃ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে অক্টোবরের শেষে সদর উপজেলার ফুকরা নামক স্থানে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয় । মুক্তিযোদ্ধারা এমবুশ করে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর । এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৪০ জন গ্রামবাসী শহীদ হয়।
৩। কোটালীপাড়ায় রাজাপুরের যুদ্ধঃ হেমায়েত বাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেমায়েতউদ্দিন বীর বিক্রম এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১৪ অক্টোবর ১৯৭১ সালে কোটালীপাড়ার রাজাপুর গ্রামে এক প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ২ জন পাক-হানাদার নিহত হয় এবং ইব্রাহিম নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় । এ যুদ্ধে হেমায়েত বাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম আহত হন।
৪। ভাটিয়াপাড়ায় আত্নসমর্পনঃ ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক-হানাদার বাহিনী আত্নসমর্পন করলে ও ভাটিয়াপাড়ার ওয়ালেস ষ্টেশনস্থ পাক সেনাদের ক্যাম্পটি দখল নিয়ে পাক-সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয় । ১৬ ই ডিসেম্বর ঐ দিন মিত্র বাহিনীর মেঃ কর্নেল জোয়ান ও ৮নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেঃমঞ্জুর প্রমুখ এর নেতৃত্বে এ যুদ্ধ সংগঠিত হয় । অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে ৪৯ জনপাক-বাহিনী আত্মসমর্পন করে।
৫। অন্যান্যযুদ্ধঃ এ জেলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গেরিলা বাহিনী দ্বারা পাক-বাহিনী আক্রান্ত হয় । এ সব যুদ্ধের মধ্যে কোটালীপাড়ার সিকির বাক্তারের যুদ্ধ অন্যতম । এ ছাড়া কেকানিয়া, পাইককান্দি, ঘোড়াদাই ও যুদ্ধ অন্যতম । এ সব প্রতিরোধযুক্ত অনেকে হতাহত হন। অক্টোবরের মধ্যভাগে হেমায়েত বাহিনী কর্তৃক লুটকৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে পাক বাহিনী কলাবাড়ি গ্রামে প্রচুর হত্যা ও ধংস যুদ্ধ চালায়।
ইতিহাসের নির্মম ৭১ এর বধ্যভূমি, জয়বাংলা পুকুর। বাস্তবিকপক্ষে এটি ছিল এসডিও অফিস সংলগ্ন পুকুর । এই এসডিও অফিসে পাক-হানাদার বাহিনী ঘাটি গাড়ে । এ স্থানে গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থান হতে মুক্তিযোদ্দাদের নিয়ে এসে নির্যাতন করে মেরে এই পুকুরে ফেলে দেয়া হত । এ ঘাটিতে অসংখ্য নারীকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করা হয়েছে । এই পুকুরে শহীদ হয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা । শহীদ হয়েছেন গুলজার হোসেন চৌধুরী, শহীদ মাহবুবুর রহমান, আসাদ শেখ, কুটি মিয়া, শওকত আলী,আব্দুল মান্নান খালাসী, সিহাবদ্দিন মোল্লাসহ অগনিতশহীদ মুক্তিযোদ্ধা এখানে প্রাণ হারান।
—তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া