অগ্রসর রিপোর্ট :ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে বুধবারের ঐতিহাসিক ও নিন্দনীয় হামলার পর, মার্কিন প্রভাবশালী শ্রেণী, ডেমোক্র্যাট, মূলধারার গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কগুলো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের কণ্ঠ্য স্তব্ধ ও বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে চলেছে। মার্কিন গণতন্ত্র সুরক্ষায় তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রেক্ষিতে এমন অবস্থান নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে, বিশ্বের অন্য যে কোনো প্রান্তে একই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং প্রভাবশালী শ্রেণী তাদের দ্বৈতনীতি চালু রেখেছে। যেমন, তাদের দাবি, ২০১৯ সালে হংকংয়ে ঘটে যাওয়া আন্দোলন এবং ক্যাপিটলের বিক্ষোভ ‘একই নয়’ ।
ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার পর, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং জনগণকে আরো একবার রাজনৈতিক অবস্থানের এমন দ্বৈতনীতি নিয়ে ভাবার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যম এখনো তাদের মিথ্যা যুক্তির ওপর জোর রেখে অস্থিতিশীল গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা রক্ষা করতে চাইছে। অন্যদিকে গত সোমবার চীনের বিশ্লেষকরা বলেছেন, ক্ষমতার রাজনীতি ও আধিপত্য ঘিরে এমন দ্বৈতনীতি দেশটিতে আরো অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ সমস্যা ঘটিয়ে উল্টো বিপদে ফেলবে।
অন্ধ হওয়ার ভান?
‘না, বেইজিং, হংকংয়ের আন্দোলনের মতো ক্যাপিটলে সেরকম কোনোকিছুই ঘটেনি’। শনিবার ওয়াশিংটনভিত্তিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের এশিয়ান স্টাডি সেন্টারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধে এমন মন্তব্য করেন সংস্থাটির সিনিয়র পলিসি বিশেষজ্ঞ অলিভিয়া ইনোস। তিনি দাবি করেন, ২০১৯ সালে হংকং আন্দোলন চলাকালে যা হয়েছে, তা ‘অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং গণতন্ত্র-পন্থী’। সাম্প্রতিক সময়ে আরো কয়েকজন পশ্চিমা বিশ্লেষক এবং সাংবাদিকরা একই মন্তব্য করেছেন।
কতিপয় মার্কিন, পশ্চিমা পণ্ডিত এবং মিডিয়াগুলোর এমন অযৌক্তিক মনোভাব চীনা মিডিয়া ও বিশেষজ্ঞরা ব্যঙ্গাত্মক বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। শনিবার বেইজিং ডেইলিতে প্রকাশিত নিবন্ধে একটি উইচ্যাট পাবলিক একাউন্ট থেকে লেখা হয়, যে সমস্ত পশ্চিমারা এমন দ্বৈতনীতির প্রচার করছে যেন ‘তারা অন্ধ অথবা অন্ধ সেজে বসে আছে। বিক্ষোভের সময় হংকং না গিয়েও তারা মিথ্যা গল্প বলছে’।
প্রকাশিত সেই নিবন্ধে বলা হয়, ‘যে সব মানুষ দেয়াল টপকে ক্যাপিটলের ভেতর গিয়েছিল, এবং পরে কংগ্রেস ভবনে সেলফি তুলেছে, তাদের তুলনায় হংকং এর বিক্ষোভকারী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অনেক বেশি ভয়ানক ছিল’।
২০১৯ সালে হংকং আন্দোলনে স্বচক্ষে দেখা এবং প্রতিবেদন করা সাংবাদিক আলেকজান্ডার ইয়ং গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, “সত্য বলতে হংকং আন্দোলনকারীদের তুলনায় ক্যাপিটাল হিলে তাণ্ডব চালানো ট্রাম্প সমর্থকরা অনেক বেশি সভ্য এবং শান্তিপূর্ণ ছিলেন। হংকংয়ের বিক্ষোভকারীরা পেট্রোল বোমা, তীর ধনুক, লোহার দণ্ড, ইট এবং ছুরি ব্যবহার করেছিল। তারা শুধুমাত্র পুলিশকেই আক্রমণ করেনি, সেইসঙ্গে রাস্তার যেসব নিরপরাধ মানুষ তাদের মতের বিরুদ্ধে ছিল, তাদের ওপরও হামলা করে। এমনকি কথিত সেই ‘অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং গণতন্ত্র-পন্থী’ আন্দোলনে সাংবাদিকদেরও নির্যাতন করা হয়”।
সাংহাইভিত্তিক গুয়ানচা ডট সিএন এর একটি অনুষ্ঠানে আলোচক ইয়াং হানয়ি বলেন, ‘তুলনা করলে দেখা যায়, ওয়াশিংটন ডিসিতে ট্রাম্পপন্থী একজন প্রাক্তন নারী সৈনিক ভাঙা জানালা দিয়ে ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে যাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাকে গুলি করা হয়, এবং ভেতরে থাকা পুলিশ কিংবা এজেন্টরা তাকে মেরে ফেলে’। তিনি উল্লেখ করেন, “প্রায় সব মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যম ট্রাম্পপন্থী সমর্থকদের জন্য ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে হংকং এর বিক্ষোভকারীদের এখনো ‘গণতন্ত্রপন্থী প্রতিবাদকারী’ বলা হয়। কতটা দ্বিমুখী আচরণ!’’
অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রাম্পের কন্ঠরোধের বিভিন্ন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে টুইটার নিজেও দ্বিমুখী নীতির আশ্রয় নিয়েছে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য দেশগুলো বাকস্বাধীনতা রক্ষায় অন্যান্য দেশের যেরূপ সমালোচনা করে থাকে, সেটি এখন ‘পুরোপুরি হাস্যকর’ হয়ে পড়েছে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ঝ্যাং ইয়ু গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, ‘এর দ্বারা প্রমাণিত হয় বাকস্বাধীনতার সীমা এখনো অনিশ্চিত’।
চীনকে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলী প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অথচ দুটো দেশই নিজ নিজ ভূমিতে দাঙ্গার পর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতার বিরোধিতা করতে চেয়েছে। ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার কারণে যে পরিমাণ অপদস্থ হতে হয়েছে, তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী শ্রেণী ও রাজনীতিবিদরা হংকংয়ের বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে তাদের সমর্থন সরিয়ে নেবে না। কারণ ‘এটা কোনভাবেই গণতন্ত্র বা আইন অথবা আদেশ জাতীয় কিছু ছিল না। এটি ছিল দুই পরাশক্তির কৌশলগত প্রতিযোগিতা’। ইনস্টিটিউট অফ ফুদান ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ফেলো সং লুঝেং এভাবেই নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন।
বিশ্বাসযোগ্যতার পতন
নেতৃত্ব নিয়ে দ্বৈতনীতি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসের পতন ঘটাবে। ধীরে ধীরে সারাবিশ্বে এটি বিশ্বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ঘটিয়ে নিজেদের বিপক্ষেই পাল্টা আঘাত করবে – এমনটাই বলছেন চীনের বিশেষজ্ঞরা।
‘দূর্ভাগ্যবশতঃ হংকংয়ের বিচ্ছিনতাবাদী এবং বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দেয়া মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ এবং জশ হাউলি বর্তমানে বেশ বিপাকে রয়েছেন। তাদের ট্রাম্পের পক্ষাবলম্বন করে নির্বাচনী ফলাফল চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে ক্যাপিটল বিক্ষোভের মত আরো সহিংসতা ডেকে আনতে পারে’। সোমবার গ্লোবাল টাইমসে এভাবেই লিখছিলেন চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ সোশাল সায়েন্স ইন বেইজিং এর রিসার্চ ফেলো লু জিয়াং।
মার্কিন গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, ক্রুজের সঙ্গে যৌথভাবে হাউলেই ছিলেন প্রথম সিনেটর, যিনি জনসম্মুখে ইলেক্টোরাল কলেজ প্রতিপত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। দুজনেই গণমাধ্যম ও কংগ্রেসে তাদের সহকর্মীদের মাধ্যমে বেশ রূঢ় সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। হংকং বিক্ষোভের সময় ক্রুজ এবং হাউলে দুজনেই হংকং এসেছিলেন এবং বিক্ষোভকারীদের প্রতি নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। এখন তাদের দুজনকেই হংকংয়ে চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কারণে জরিমানা করেছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
লু বলেন, ‘কেবল চীন বা হংকং না, ইউক্রেন, মিশর এবং দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশেও সহিংসতাকে সমর্থন প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ এবং গণমাধ্যমগুলো। আমেরিকানদের মাঝে অনেকেই বিশ্বাস করে, ‘গণতন্ত্র’কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হলে আক্রমণকারী পুলিশ, কঠোর সরকার বা আইনি সংস্থাগুলোই সঠিক। ক্যাপিটলে ঘটা দাঙ্গা এরকমই পালটা আঘাতের সবশেষ উদাহরণ’।
লু আরো উল্লেখ করেন, “যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম আর জনগণের বুঝা উচিত, হংকং এবং ওয়াশিংটন ডিসি’র বিক্ষোভকারীরা একই রাজনৈতিক মূল্যবোধ ধারণ করে। অভিবাসনের বিরোধী, প্রতিষ্ঠার বিরোধী, যৌক্তিকতার বাইরে সহিংসতার মাধ্যমে যারা নিজেদের লক্ষ্য প্রকাশ করতে চায়। তাই যখন আপনি হংকং এর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহিংস ও চরমপন্থী আচরণকে উৎসাহিত করবেন, তখন ট্রাম্পের অনুগতদেরও ‘গর্বিত সন্তান’র মত উৎসাহ দিচ্ছেন”।
চীনের বিশেষজ্ঞরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কেবল বাইরের সহিংসতা নিয়েই দ্বিমুখী আচরণ করে না, একইসঙ্গে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নিয়েও ভিন্ন এক মনোভাব প্রকাশ করে। যে আন্দোলনও ২০২০ সালে বিভিন্ন শহরে আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করার কারণে নৃশংসতার দিকে চলে যায়। সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি সরাসরি প্রতিবাদকারীদের সমালোচনা না করে ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা করার দিকে মনোনিবেশ করে। কিন্তু যখনই ট্রাম্প সমর্থকরা একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তখনই তাদের ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ বলা হয়েছে।
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝ্যাঙ বলেন, ‘ট্রাম্প কেবলই একজন প্রেসিডেন্ট না। তাকে পছন্দ করা হোক বা না হোক, তিনি জনগণের মতামতের ভিত্তিকে এগিয়ে থাকা একজন মানুষ, যিনি ৭৪ মিলিয়ন আমেরিকান জনগণের ভোট পেয়েছিলেন। ট্রাম্পকে স্তব্ধ করে দেয়া মানে, মার্কিন রাজনীতির একটি প্রভাবশালী আদর্শকে স্তব্ধ করে দেয়া’।
পাশ্চাত্যের অন্যতম শ্রদ্ধেয় নেতা, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মর্কেল ট্রাম্পের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিমত পোষণ করেন। সোমবার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র এপি’কে জানিয়েছেন, তিনিও (অ্যাঙ্গেলা মর্কেল) বিশ্বাস করেন টুইটার থেকে ট্রাম্পের ব্যান হওয়া ‘সমস্যা তৈরি করবে’।
লু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখনো আরো অনেক সহিংসতার সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে, যা ক্ষমতায় বসতে যাওয়া বাইডেন প্রশাসনের চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি কংগ্রেসেও রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে থাকবে। যার অর্থ, ট্রাম্প প্রশাসনের ‘এক ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা’ উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে চলেছেন জো বাইডেন।
ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের সং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা ব্যাপকহারে কমে এসেছে। এমনকি পশ্চিমা নেতা এবং গণমাধ্যমও নিয়মতান্ত্রিক সংকট থেকে বর্তমান বিশৃঙ্খলাকে ‘ট্রাম্পের তৈরি করা ব্যতিক্রম অবস্থা’ নাম দিয়ে বের করে আনার চেষ্টা করছে। তিনি আরো বলেন, “তারা আর কখনোই অন্য দেশগুলোকে বুঝাতে পারবে না যে, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার হস্তান্তর অনেক শান্তিপূর্ণ। এবং এটাও বলা সম্ভব না যে, ‘এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি’ ন্যায্যভাবে শেষ হয়ে কখনোই জনগণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে না”।
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস